মাহমুদুল হক ফয়েজ
করিম বিশ্বাস নামে আমাদের গেরামে একটা লোক আছিলো। হের বহুত তালগাছ। বাইশটা। বেগ্গুনাতে তাল ধরতো। একদিন তারে কইলাম ‘মামু’ আমারে একটা তাল দ্যাও। হেয় কইলো, যা গিয়া, তোর পেটে তাল যাইবো না। আমার তখন বয়স আছিলো নয় দশ বছর। মামুর কথা শুইন্না খেদ চাইপা গেল। গায়ে জ্বালা ধইরা গেলো। মামুরে কইলাম ‘ঠিক আছে’। তয় আমার মাথা যখন গরম হইলো, আর কিছু ভালা লাইগলো না। আমি তালিবালি কইরা দুইশ টাকা জোগার কইরলাম। পরদিন মামুর কাছে গিয়া কইলাম, মামু একটা গাছের তাল কত নিবা। মামু চোখ ছোট্ট কইরা আমার দিকে চাইয়া একশ টাকার তাল চাইলো দুইশ টাকা। আমি কইলাম সই। তাই দিমু। মামু তাল দ্যাও। দুইশ টেকা তারে হাতে দিয়া কইলাম গাছের তাল কাট। মামু গাছের তাল কাইটা থুবাইলো। এমন সময় তার বড় ভাই আইস্যা শোর চিৎকার শুরু কইরলো। আমারে তাল ফিরত দিতে কইলো।
হেরা হেরা লাইগা গেলো। এই ফাঁকে আমি তাল নিয়া চইলা আসি। তাল বাজারে আইন্না বেচা শুরু কইরলাম। খেদের তাল খাইলাম। যেই মামু আমারে তাল দিলো না, হেই মামুর তালের খেদেই আমি তাল বেচা শুরু করি। মামুই তালের ডাব বেচইন্না বানাইলো। হেই যে তালের ডাব বেচা শুরু কইরলাম। এখন আমার বয়স পঞ্চাশ। আইজও হেই ব্যবসাই করি'।
রায়পুর উপজেলার চর বংশী ইউনিয়নের খাসের হাট বাজারে পঞ্চাশ বছরের দুলাল মিয়া একটা সিগারেটে সুখের টান দিতে দিতে বলছিলেন তার ব্যবসা শুরুর কথা। মানুষের মাথায় যখন জিদ চাপে, তখন তার ইচ্ছা পূরণটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। দুলাল মিয়া সে ইচ্ছা পূরণ করেই ান্ত হয়নি, সেই ইচ্ছাটা আজো ধরে রেখেছেন সযত্নে।
এক দঙ্গল ছেলে মেয়ে ঘিরে রেখেছে দুলাল মিয়াকে। আর তিনি ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে তালের ডাব থেকে শাঁশ তুলে দিচ্ছিলেন ওদেরকে। গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েরা সে সুস্বাদু তালের ডাব পরম তৃপ্তিতে সেখানে বসেই খেয়ে নিচ্ছে।
আমি রায়পুর যাব। নাইয়া পাড়া থেকে ফিরছিলাম। বংশী থেকে আসা রায়পুরের বাস এখুনি ছেড়ে যাবে। অল্পণের জন্য থেমেছে খাসেরহাটে। সময় বেশি নেই। দুলাল মিয়া তালের ডাব দেখিয়ে বল্লেন, স্যার খাবেন। এর মধ্যে ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে আরো ঘিরে ধরেছে। আমি ক্যামেরা বের করে ছবি তুললাম ফ্যাশ জ্বলে উঠতেই মুখের আধাপোড়া সিগারেট ফেলে চোখ জ্বল জ্বল করে বল্লেন,
ও আপনি সাম্বাদিক। একটা খান স্যার পয়সা লাগবো না।
দুলাল মিয়া কিছুটা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আমি হেসে বল্লাম, খাব না।
স্যার, এগুলা সব ভিটামিন। ম্যাইনষে তো কিছু বুঝে না, ইন্ডিয়ার পঁচা আঙ্গুর খাইবো। দ্যাশের ডাব খাইবো না, দেশের ফল খাইবো না। স্যার আপনার তালের ডাব লাইগলে কইয়েন। যত ট্রাক লাগে দিতে পারুম।
আমি বল্লাম, এত ডাব কোথায় পাবেন।
আর একটা কচি তালের ডাবে কোপ দিতে দিতে দুলাল মিয়া হেসে বল্লেন,
স্যার, আমি তো এই ব্যবসাই করি। গেরামের তালের ডাবগুলা গাছে থাকতেই গিরস্তের থেইকা কিনা ফেলাই। তারপর আস্তে আস্তে বেচি। সাপ্লাই দেই। আমার থেইক্কা কত ম্যাইনষে নেয়।
আপনার বাবাও এ ব্যবসা করতেন? আমি জানতে চাইলাম। ‘না না , উনি গিরস্তের কাম কইরতো। ওই যে কইলাম খেদের থেইকা ব্যবসা ধরছি।
আপনার বাড়ি? বাবা আছেন?
দঙ্গল ছেলে মেয়েদের সামলাতে সামলাতেই বল্লেন।
আমার চর বংশী মিজি বাড়ি। কোডেক অফিসের কাছে। বাবা ইসমাইল মিজি। বুড়া অইয়া গেছে।
ছেলে মেয়ে?
দুই মেয়ে দুই ছেলে। এক মাইয়ারে বিয়া দিছি। বড় ছেলেডা বিয়া কইরা অন্য কাজ করে।
দুলাল মিয়া উদাম গায়ে তালের ডাবের পশরার পাশেই একটা ছেঁড়া চটের বস্তার ওপর বসা। নিজের রাজ্যে যেন নিজেই রাজা। ছেঁড়া চট তার সিংহাসন। মধ্য বৈশাখের প্রচন্ড গরম। আরো কি যেন বলতে চাইছিলেন দুলাল মিয়া। ছোট্ট লক্কর ঝক্কর বাসের ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিলো। আমি দৌড়ে গাড়িতে উঠলাম। হেলে দুলে গাড়ি সামনে চলছে। দু পাশে ঘন নিবীড় সবুজ গ্রাম। নারিকেল সুপারির বাগান। অপূর্ব স্নিগ্ধতা। ভাবছিলাম পাতলা শরীরের মধ্যম বয়সী দুলাল মিয়ার কথা। জিদে জিতে সব মানুষই রাজা হয়।
তাই তো। ‘জিদে জিতলে সবাই রাজা’।
(TEXT)
জিদে জিতলে সবাই রাজা">জিদে জিতলে সবাই রাজা
মাহমুদুল হক ফয়েজ