নোয়াখালীর নতুন নতুন চর ও ভূমিহীন পুনর্বাসন
উপকূলীয় জেলা নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলের রয়েছে ভাঙ্গাগড়ার এক বৈচিত্র্যপূর্ণ ইতিহাস। শত বছর ধরে মেঘনা আর সাগরে ভেঙ্গেছে লোকালয় জনপদ। আবার প্রকৃতির অপার মহিমায় সাগর থেকে জেগে উঠেছে হাজার হাজার একর নতুন ভূমি। এই নতুন ভূমি যেমন জেলা তথা দেশের জন্য বয়ে এনেছিলো অপার সম্ভাবনা। তেমন করে আবার এই জেগে উঠা পলিমাটিই মানুষের লাল রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বার বার। এ জমিগুলো নিয়ে চলছে দখল পাল্টা দখলের লড়াই। জেগে উঠা এসব চর গুলো কৃষির জন্য খুবই উর্ব্বর। উপকূলের মানুষ রক্তঘাম ঝরিয়ে এখানে উৎপাদন করছেন নানান ফসল। এগুলো সরকারী খাস জমি। এই খাস জমি পাওয়ার অগ্রাধিকার রয়েছে ভূমিহীনদের। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য যে এসব খাসজমির উপর লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে উপরতলার প্রভাবশালী মহলের। নানান কায়দায় এরা গোগ্রাসে গিলে খাচেছ এসব খাস জমি। এ নিয় গত ২৬-২৯ জুলাই ২০০৮ 'উপকূলে ভাঙ্গাগড়ার খেলা' শিরোনামে দৈনিক প্রথম আলো পর পর কয়টি সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যা সচেতন পাঠক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
জেলার দক্ষিণে মেঘনা নদীর মোহনা, হাতিয়া নদীর তীর ও বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে সাম্প্রতিককালে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে জেগে উঠছে লক্ষ লক্ষ একর নতুন ভূমি। এছাড়াও সাগর মোহনায় সৃষ্টি হচ্ছে ছোট বড় অসংখ্য দ্বীপ। বয়ার চর, নলের চর, নাঙ্গলিয়ার চর, জাহাজ্জার চর, কেরিং চর, নিঝুম দ্বীপ, চর কমলা ইত্যাদি চরগুলোতে ইতিমধ্যে বাস করতে শুরু করেছেন অসংখ্য মানুষ। এদের অনেকেই সহায়-সম্বলহীন ভুখানাঙ্গা অসহায় ভূমিহীন কৃষক। এই বসতির সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সরকারের কোনোরুপ সাহায্য সহযোগীতা ছাড়া এরা উৎপাদন করছেন নানান ফসল। ধারনা করা হয় এখন সেখানে এক থেকে দেড় লক্ষাধিক ভূমিহীন ইতিমধ্যে বসতি স্থাপন করেছেন। এদের কারোরই কোনো বৈধ কাগজ পত্র নেই। প্রশাসন, স্থানীয় জোতদার আর ভূমিদস্যুদের আতঙ্কে এরা থাকেন সদা সন্ত্রস্ত। স্থানীয় ভূমিদস্যুদের কাছে এরা অনেকটাই জিম্মি হয়ে আছে। এ ভূমিদস্যুরাই ঠিক করে দিচ্ছে কে কতটুকু জমি পাবে। নিজেরাই জমি গুলো মাপজোক করে বিক্রি করছে ভূমিহীনদের কাছে। তাদের কাছ থেকে এরা আবার ক্ষছর বছর চাঁদা আদায় করে নেয়। আর আছে চিংড়ি মৎস্য ইত্যাদি প্রকল্প করার নামে উপরতলার কিছু ভূমিখোর লুটেরা মুৎসুদ্দি গোষ্ঠি। হামলা মামলা কুটবুদ্ধিতে এরা সিদ্ধহস্ত। স্থানীয় প্রশাসন এমনকি রাষ্ট্রিয় নীতিনির্ধারন পর্যন্ত এদের হস্ত প্রসারিত। লাঠিয়াল ভূমিদস্যুদের কাজে লাগিয়ে এরা জমি দখল নেয়। আবার নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে। ভূমিবানিজ্যও চলে। নোয়াখালীর চরে এগুলোর রমরমা ব্যবসা। এসব খবর স্থানীয় প্রশাসনের অজানা নয়। পত্রপত্রিকায় মাঝে মাঝে খবর আসে। ভিতরের খবর বেশীর ভাগ থাকেনা। উপকূলীয় এই খাসজমি নিয়ে কাড়াকাড়ি দীর্ঘদিনের। অসংখ্য রক্ত ঝরেছে এই জমি নিয়ে।
একাত্তরে স্বাধীনতার পর পরই সমুদ্র বা নদীবে নূতন চর জেগে উঠার প্রক্রিয়া তরান্বিত করতে নেদারল্যন্ড সরকারের সহযোগীতায় ভুমি উদ্ধার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিলো। জেগে উঠা চরসমূহে বনায়নের মাধ্যমে মাটির স্থায়িত্ব বৃদ্ধিকরণ এবং এসব চরকে ক্রমান্বয়ে চাষাবাদ এবং বসবাসযোগ্য ভূমিতে রূপান্তর করার উদ্দেশ্যে ষাট এর দশক হতে উপকূলীয় বনবিভাগ ব্যপক বনায়নের কার্যক্রম শুরু করে। দৃষ্টিনন্দন মানবসৃষ্ট এইসব ম্যানগ্রোভ বাগান ঘূর্নিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে উপকূলবাসীর জানমাল রক্ষায় এক বিশাল সবুজ বেষ্টনী গড়ে উঠে। প্রায় এক দশক আগে হঠাৎ করে এসব বনাঞ্চল একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহলের প্রত্যক্ষ ও পরক্ষ মদদে কতিপয় সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যায়। জবরদখলকারী এসব সন্ত্রাসীরা নির্বিচারে গাছ কেটে, পুড়িয়ে, বনভূমিকে সাধারণ ভূমিতে পরিণত করে। তিন চার বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ চরাঞ্চল জবরদখলদারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং নদীভাঙ্গনের শিকার হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা ও বরিশালের হতদরিদ্র ভূমিহীনদের মাঝে সন্ত্রাসীরা এসকল জায়গা বিক্রি করতে থাকে। এসমস্ত ভূমিহীন পরিবারেরা ক্রমান্বয়ে জবরদখলকৃত এসব ভূমিতে আবাদ করে ঘরবাড়ী তুলে বসবাস করতে শুরু করে। অত্যন্ত দূর্ভাগ্যজনক সত্য যে, বনবিভাগ এসব সন্ত্রাসী গ্রুপকে দমন করার জন্য কখনো কখনো পুলিশ, বিডিআর, কোষ্টগার্ড ও বনবিভাগ সমন্বয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে যৌথ অভিযান চালিয়েও সন্ত্রাসীদের দমন কিংবা উচ্ছেদ করতে পারেনি।। উপরন্তু তাদের রোষানলে প্রাণ দিতে হয়েছে বনবিভাগের একজন বিট কর্মকর্তাকে। গুরুতর আহত হয়েছেন অনেক বন কর্মচারী ও পুলিশ। তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে বনবিভাগের কয়টি বিট অফিস। অনন্যপায়, আশ্রয়হীন, সহায়সম্বলহীন মানুষেরা দীর্ঘদিন এসব চরাঞ্চলে সন্ত্রাসীদের প্রজা হিসাবে বসবাস করে আসছিলো। এইসব জবরদখলকারীরা নির্বিচারে বনধ্বংসের পাশাপাশি নানান অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে যেতো। এদের কাছে নিরীহ ও সাধারণ ভূমিহীন জনগণ অসহায় হয়ে পড়ে। যেহেতু দূর্গম এলাকায় তাদের বসতি, সেহেতু সরকারের তরফ থেকে এদের নিরাপত্তা বিধান করাও কঠিন ছিল। গত এক দশকে এসব চরাঞ্চলে কি পরিমাণ ধর্ষণ, লুট, খুন, হয়েছে তার হিসাব কষে দেখাও সম্ভব হয়নি। জনশ্র“তি আছে এদেরকে মদদ দিত সেসময়ের স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা আর কিছু শিল্পপতি। ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে বনদস্যু নিধনের নামে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ৩৯জন মানুষ। অভিযোগ রয়েছে এরাই আবার দখল করে নেয় সরকারী অনেক খাসজমি।
বয়ার চরে দৃশ্যতঃ রক্তাক্ততা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। এখানে চর উন্নয়ন সংস্থার সক্রিয় তত্ত্বাবধানে কিছু ভুমিহীনের পুনঃর্বাসন করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য চরে ভূমিদস্যুরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠছে। গজিয়ে উঠছে নতুন নতুন বাহিনী। চিংড়ি ও মৎস্য প্রকল্প নামে প্রভাবশালীরা জবরদখল করে নিচ্ছে হাজার হাজার একর খাস জমি। এসব জমি দখলের জন্য এরা বিভিন্ন সন্ত্রাসীদের ভাড়া করছে। প্রভাবশালীরা সেখানে গড়ে তুলছে বিশাল বিশাল মাছের খামার। অথচ এসব খাস জমিগুলো ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে পরিকল্পিত ভাবে বিতরন করলে ফসল উৎপাদনে ব্যপক ভূমিকা রাখা যেতো।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কৃষকদের জন্য ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ পদ্ধতি অনেকের কাছে খুব গ্রহণযোগ্য ছিলো। একই বাড়িতে হাঁস মুরগী গবাদিপশু পুকুরে মাছ বাড়ির চতুর্দিকে ফসল ও ফলদবৃ শোভিত সবুজঅরন্যে ঘেরা কৃষক-বাড়িগুলো হবে এক একটি ছোট ছোট কৃষি উৎপাদনমুখী খামার। সরকার পরিবর্তনের পর সে পরিকলপনাটি তিমিরেই মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।
এক সময় নোয়াখালীর উপকূলীয় এ চর গুলোতে গরু মহিষ ভেড়ার ছিলো অবাধ বিচরণত্রে। নোয়াখালীর প্রয়াত জননেতা আব্দুল মালেক উকিল এলাকার গুরুত্ব অনুধাবন করে নোয়াখালীর চরে একটি চারণত্রে নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। যেখানে সাধারণ কৃষকদের গবাদি পশু অবাধে বিচরণ করতে পারতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের পর সে চারণত্রে বেদখল হয়ে যায়। নোয়াখালীর চরে বিপুল ভূমি থাকা সত্তেও সাধারণ কৃষকের কথা বিবেচনা করে চারণেেত্রর জন্য আর কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি।
নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ চরভূমির লক্ষ লক্ষ নিরীহ জনসাধারণের উপর থেকে দূরীভূত হয়নি জীবনের নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা, অসহায়ত্ব, দারিদ্র আর অধিকারহীনতা। আধিকাংশ চরে স্থানীয় সরকার নেই, কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই, কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই, স্কুল নেই। হাজার হাজার শিশু পড়ালেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব জমিতে তাদের সরকারী মালিকানাও নেই। নেই কোন নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা। দু’একটি চরে কয়টি এনজিও শুধু ঋণ কর্মসূচী নিয়ে কাজ শুরু করেছে । বয়ারচর ছাড়া বাকী কোন চরে চলাচলের কোন রাস্তাঘাট নেই, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নেই। নিরীহ জনসাধারণের বসবাসের ঘরগুলিও খড়কুটা দিয়ে তৈরী। যেকোন ছোট খাট ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাস নিমিষেই কেড়ে নিতে পারে ল ল প্রাণ। এদের প্রধান জীবিকা কৃষি এবং মৎস্য শিকার। কৃষিও তাদের হুমকির সম্মুখীন। বেড়ীবাঁধ না থাকার কারণে অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে প্রায়ই তাদের ফসল এবং ঘরবাড়ী তলিয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে তারা কাজের সন্ধানে মূল ভূখন্ডে চলে আসে। মানবতার স্বার্থেই আজ এসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো জরুরী। এসব সাধারণ ও নিরীহ ভূমিহীন পরিবারদেরকে সংগঠিত এবং সম্পৃক্ত করে তাদের মাধ্যমেই সমন্বিত উৎপাদনমূলমক কার্যক্রম গ্রহনের মাধ্যমে তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিষয়টি সদয় বিবেচনায় এনে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলিকে এগিয়ে আসতে হবে। ভূমি দখলদাররা যতই শক্তিশালী হোকনা কেন তাদের আগ্রাসন থামাতে না পারলে উপকূলের লোনা জল আর মানুষের লোনা রক্তে এ উর্ব্বর মাটি আরো একাকার হয়ে উঠবে।
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিক