মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
বাংলাদশের উপকূলীয় অঞ্চলে যাঁরা বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছেন, ঝড় তুফান জলোচ্ছাসকে তাঁরা সহজাত ভাবেই বরণ করে নিয়েছেন। ঝড় ঝঞ্ঝা গর্কীতে সব কিছু লন্ড ভন্ড হয়ে যাওয়ার পরও তারা চেষ্টা করেন আবার নিজেদের মত করে ঘুরে দাঁড়াতে।
সত্তুরের ১২নভেম্বরে বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে যে ভয়ঙ্কর জলোচ্ছাস আঘাত হেনেছিলো তাতে প্রাণ হারিয়েছিলো কয়েক লক্ষ মানুষ। ধ্বংস হয়েছিলো কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ ও উঠতি ফসল। সেদিন কত মানুষের মৃত্যু হয়েছিলো তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা না গেলেও দেশী বিদেশী পর্যবেক্ষক ও প্রচার মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী ধারনা করা হয় সেদিনের ধ্বংযজ্ঞে দশলক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলো। সরকারী হিসাবে অবশ্য বলা হয় পাঁচ লক্ষ। সে দুর্যোগের রাতে সমুদ্রের ফেনিল জলোচ্ছাস তার রুদ্র রুক্ষতায় লন্ড ভন্ড করে দিয়ে গিয়েছিলো উপকূলের কোলাহলময় জনপদ। প্রায় পঁচিশ ত্রিশ ফুট উঁচু পাহাড় সমান ঢেউ আছড়ে পড়েছিলো উপকূলে। বাতাসের গতিবেগ ছিলো ঘন্টায় প্রায় আড়াই শ’ কিলোমিটার। রমজান মাস ছিলো তখন। প্রকৃতিতে ছিলো হেমন্তের মিষ্টতা। বছরের এ সময়টা থাকে ধান কাটার ভরা মৌসুম। তখন ক্ষেতে ক্ষেতে ধান কাটার ধুম চলছিলো। আনেকেই ধান কেটে স্তুপ করে রেখেছিলেন। ধান মাড়াইও চলছিলো। কৃষাণ বঁধুরা ছিলেন ব্যাস্ত। শিশু কিশোরদের হৈ চৈ উল্লাস। সে সময় নানান অঞ্চল থেকে শ্রমিকরা এসেছিলেন ধান কাটার জন্য। উপকূলে একটা উৎসবের আমেজ বিরাজ করছিলো। সে রাতে এ সবকিছু নিমেষেই নিস্তব্ধ ধ্বংস স্তুপে পরিনত হয়ে যায়। পলকে স্নিগ্ধ উপকূল পরিণত হয় বিরান প্রান্তরে।
সাগরের কাছাকাছি উপকূলে যেসব মানুষ বাস করেন তাঁরা প্রাকৃতিক দৈবপাকের কিছু আলামত শত শত বছর ধরে লোকজ জ্ঞানের মাধ্যমে ধারনা করে থাকেন। অনেক সনাতন জেলেদের কাছ থেকে জানা গেছে সাগরে কোনো বড় জলোচ্ছাসের আগে সাগরের নানান রকম মাছের বিচিত্র রকম আনাগোনা শুরু হয়। সাগরের পানির রঙের পরিবর্তন হয়। আকাশে মেঘের আনাগোনা, শীতের শুরুতে অতিথি পাখীদের উড়ার ভঙ্গি, পোকা মাকড়ের গতিবিধি ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে এরা বলতে পারতেন আগাম দুর্যোগের কথা। নোয়াখালীর বন বিভাগের এক কর্মকর্তা হাতিয়া দ্বীপের জাহাজমারা আর নিঝুম দ্বীপে কর্মরত অবস্থায় অবলোকন করেছিলেন দুর্যোগের সময় কাকদের গতিবিধি। তিনি দাবি করেছেন সাগর পাড়ের কাকেরা এ সময় কিছু অস্বাভাবিক আচরণ করে যা দেখে সঠিক ভাবে দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। তবে সাগর পাড়ের মানুষজন আবহাওয়ার যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশী আভিজ্ঞ তা হলো, সাগরে ঝড় জলোচ্ছাসের অনেক আগে থেকে আকাশ ঝেঁপে একটা গুমোট ভাব পরিলক্ষিত হয়। বছরের এক একটা মৌসুমে তার এক এক রকম ভাব। আশ্বিন কার্তিক মাসে শীতের প্রাক্কালে সাগরে ঝড়ের প্রাদুর্ভাব বেশী থাকে। এসময় প্রকৃতিতেও চলে নানান উপসর্গ। ঝড়ের পূর্বে তখন শরীরে এক ধরণের গাজ্বালা গরম অনুভূত হতে থাকে। নোয়াখালী অঞ্চলে এধরনের গরম লাগাকে বলে ’উনতাল্লা’ গরম। আর ঝড়ের তীব্রতার উপর নির্ভর করে এই গরমের ধরণ। উপকূলের অভিজ্ঞ মানুষ এ থেকে আগেই আঁচ করে নেন আসন্ন দুর্যোগের। ভাদ্র মাসের অমাবস্যা পুর্ণিমাতেও সাগরে অস্বাভাবিক জোয়ার দেখা দেয়। তখন প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়মে সাগর আপনাতেই ফুলে ফেঁপে উঠে। সত্তুর সনের ১২নভেম্বরেও ঝড়ের পূর্বে নোয়াখালী অঞ্চলের প্রকৃতিতে এরকম অস্বাভাবিক আচরণ দেখা গিয়েছিলো।
কয়েকদিন থেকে অসয্য গরমের পর ১২নভেম্বরের আগের দিন থেকে গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি হতে লাগলো। তখন অনেকেই আশংকা করেছিলেন ঝড় জলোচ্ছাসের। রেডিওতে মহাবিপদ সংকেত দিচ্ছিলো বার বার। তখন ছিলো পাকিস্তান আমলের শেষ সময়। সরকারের পক্ষ থেকে সে সময় কোনো ব্যাবস্থা নেয়া হয়নি। উপকূলের মানুষও তেমন গা দেয়নি। সেই ১২ নভেম্বরের মাত্র বিশ দিন আগে ২৩ অক্টোবর উপকূলে আর একটি সামুদ্রিক ঝড় আঘাত হেনেছিলো। সে ঝড়টি তেমন মারাত্মক ছিলোনা। উপকূলবাসী মনে করেছিলেন এ ঝড়টিও হয়তো তেমন মারাত্মক হবেনা।
১২নভেম্বর ছিলো ভরা পূর্ণিমার রাত। সেদিন বিকাল থেকে শুরু হলো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর দমকা বাতাস। যতই রাত বাড়তে লাগলো ততই বাতাসের বেগ বেড়ে যাচ্ছিলো। তারপর ঠিক মধ্যরাতের পর পরই সমুদ্র থেকে পঁচিশ ত্রিশ ফুট উঁচু পানির ঢেউ আছড়ে পড়লো উপকূলে। জলোচ্ছাস থেকে সেদিন যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁরা জানিয়েছেন, সে পানি ছিলো অত্যন্ত ঠান্ডা। বাতাস ছিলো তীব্র। আবহাওয়া দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছিলো, সেদিনের বাতসের গতি ছিলো প্রায় দুইশ’ত্রিশ থেকে আড়াইশ’কিলোমিটার। পুর্ণিমার ভরা জোয়ার আর গর্কীতে সৃষ্ট সাগরের তীব্র স্রোতে নিমেষে ভাসিয়ে নিয়েছিলো লক্ষ লক্ষ মানব সন্তান, গরু মহিষ গবাদি পশু সহ কৃষকদের সহায় সম্পদ। সে জলোচ্ছাস সরাসরি আঘাত হানে পটুয়াখালী ভোলা মনপুরা ও নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ উপকূলে।
স্বাধীনতা পূর্বে তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী এই মহা দূর্যোগকে তেমন গা দেয়নি। নির্লজ্য ভাবে তারা উপেক্ষা করেছিলো একে। বিশ্বের মানুষ বিদেশী প্রচার মাধ্যম থেকে প্রথম জানতে পারে এই জলোচ্ছসের কথা। দিনের পর দিন বিরান প্রান্তরে উদাম পড়েছিলো হতভাগ্য মানুষের লাশ আর লাশ। নারী পুরুষ শিশু আর গবাদী পশুর লাশ একাকার হয়ে গিয়েছিলো। লাশের পঁচা গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিলো। এক একটি গর্তে পঞ্চাশ ষাট জন মানুষকে কোনো রকমে কবর দেয়া হয়েছিলো তখন। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ছাত্র যুবক সেদিন দিন রাত পরিশ্রম করে মৃত দেহগুলো সৎকারের ব্যাবস্থা করেছিলো।
সেদিনের বাংলার এই মহা দুর্যোগে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কেউ এই অসহায় মানুষদের কাছে আসেনি। তখন পল্টন ময়দানে মজলুম জননেতা মওলানা ভাষানী প্রথম প্রতিবাদ করে উঠেছিলেন। কেন্দ্রীয় কেউ না আসায় তিনি এর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন । বাংলাদেশের মানুষ তখনই অনুভব করেছিলো আপদে বিপদে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কোন দিনই বাংলার মানুষের কাছে আসবেনা, পাশে দাঁড়াবেনা। বস্তুত এই মহাদুর্যোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আর এক প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছিলো।
এসব দুর্যোগকে মোকাবিলা করতে উপকূলের মানুষ অনেকটাই অভ্যস্ত। এসব দুর্যোগের পরপরই আবার নতুন করে জীবন শুরু করে তারা। এ সব ঝড় তুফানকে কি ভাবে বুকের সীনা দিয়ে ঠেকাতে হয় এগুলো তারা জন্ম থেকেই রপ্ত করে নেয়। জন্ম থেকেই এটা যেন তারা শিক্ষা লাভ করে। বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা আর বর্তমানে সহজ যোগাযোগ ও সহজ তথ্য প্রবাহের ফলে মানুষের সনাতন জ্ঞান বা লোকজ জ্ঞান গুলো হারিয়ে যাচেছ। নানান ভাবে আমরা এখন এ সকল জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজস্ব জ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন করে পরনির্ভরশীল করে তুলছি । সরকারী বেসরকারী উদ্যোগে সে সব কিছুকে আমাদের সংরক্ষণ করা অতি প্রয়োজন। নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলে এ সব লোকজজ্ঞানের অনেক চর্চা এখনো হয়ে থাকতে দেখা যায়।
ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে উপকূলে বার বার ঝড় ঝঞ্ঝা আঘাত হানে। কখনো কখনো সব কিছু লন্ড ভন্ড হয়ে যায়। এ সব কিছুকে তুচ্ছ করে সাহসী মানুষগুলো আবার খাড়া হয়ে উঠে। গত বছরেরর মধ্য নভেম্বরের সিডরের পর পরই কারো মুখাপেক্ষি না থেকে উপকূলের জেলেরা ভাঙ্গা নৌকা ছেঁড়াজাল নিয়ে আবার সাগরে নেমেছিলো। যেকোনো দৈব দুর্যোগে উপকূলের মানুষদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন মানষিক ভাবে শক্তি সঞ্চয় করার জন্য উৎসাহিত করা। দুর্যোগ মোকাবিলা করার সনাতন কলাকৌশল গুলোকে আরো বেশী কার্যকর করা।
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ