জীবন যেমন
সাগরের ভাষা না বুঝলে সাগরে যাওন যায় না
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
সাগর পাড়ের মানুষজন। সাগরের সঙ্গেই আষ্টেপৃষ্ঠে বেধেঁ রেখেছে তাদের জীবন। সাগর ওদের মাঝেমাঝে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কখনও মারে মরণ ছোবল। তবুও সাগরেই ওদের জীবন, সাগরেই ওদের প্রাণ। মেঘনার মোহনায় রামগতির চর আলেকজান্ডারের জাহাঙ্গীর মাঝি। ঠিক নদীর পাড়েই আসলপাড়ায় বাড়ি তার। নদী আর সমুদ্রের সঙ্গে যার আজীবন সখ্যতা। ইলিশের ট্রলার নিয়ে সঙ্গীসাথীহীন ছুটে যায় মাঝ দরিয়ায়। সেই ছোট্র বয়স থেকে চাচা ফজল আহম্মদ মাঝির হাত ধরে সমুদ্র যাত্রা। চাচাই তার ওস্তাদ। এ নদীতে সাধারনত: আষাঢ় - শ্রাবন - ভাদ্র মাসেই ইলিশের মৌসুম। এ বছর তেমন ইলিশ নেই, কি এক অজানা কারনে। শুরুতে জোয়ার এলেই ভাসাতে হবে ট্রলার। যাত্রা হবে আজই । নদীর বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে বহদ্দারহাটের পাশের জেলেপল্লীতে। রামগতির এ অংশ ভাঙছে তীব্র বেগে। কাদা-জলে আছড়েপড়া নদীর স্রোতে ছলাৎ শব্দ ওঠে। দূর আকাশে ভাদ্রের ছেড়াঁ ছেড়াঁ সাদা মেঘ। দক্ষিনে সমুদ্রের হাওয়া হু হু বয়ে যায়। সাগরসঙ্গমের আকাঙ্খার এই উম্মাত্তাল মাদকতা বয়ে যায় বুঝি এই মাঝিদের দেহ - মনে। জালের ভাজঁ খুলে খুলে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ে জাহাঙ্গীর মাঝি। এখন তার ভরা যৌবন। দেরি তার যেন আর সয় না। সাগর যে তার প্রিয় সখা। দূর সাগর তারে হাতছানি দেয়।
ডর করে না ?
‘ডর কইরবো ক্যান, সাগরে যাইতে হইলে সাগরের ভাষা বুঝন লাগে। সাগরের ভাষা না বুঝলে সাগরে যাওন যায় না।’
জাহাঙ্গীর মাঝি হাসে। এক রহস্যের বন্দরে রসিকতার নোঙর ফেলে যায়।
‘পিরিতের মানুষ কি হগল সময় পিরিতের কথা কয় ? তারে দেইখ্যা বুইঝ্যা শুইন্যা পিরিত না করলে মরণ। সাগরও হে মুইখ্যা’।
কেমন করে সাগরের ভাষা বোঝেন ?
‘সাগরের ভাষা বুইঝতে আমরা পত্থমে চাঁদের হিসাব করি। অমবস্যা- পূর্নিমায় জোয়ারের হিসাব আমগো কাছে আছে। তারপর করি মাসের। কোন মাসে সাগরের হাব- ভাব মন - -মেজাজ কেমন থাকে,বুইজতে হয়। বারিষার বৃষ্টি হয় । সাগরে পানি বাড়ে কিন্তুক গরম হয় না।
কখন গরম হয় ?
‘চৈত্র - বৈশাখ মাসে আর শ্রাবনের শেষ থেইক্যা ভাদ্র আশ্বিন মাসে।’
তখন ক্যামন হয় ?
জাহাঙ্গীর মাঝি একটু যেন গম্ভীর হয়ে উঠল। উত্তর - পশ্চিম কোনে মুখ ফিরিয়ে হাতের ইশারায বলে,
‘ঐখানে কালো মেঘবাসা বাঁধে। পরে সেইখান থেইক্যা দাঁত খিচাইযা ধাইযা আসে। তখন যদি সাগরে জোয়ার থাকে, তয় অসুবিধা কম হয়। জোয়ার তো তখন উত্তর দিকে যায়। বাতাস আসে উত্তর দিক থেইক্যা। আর ঝামিলা হয় ভাটার সময়। তখন আমরা সাবধানে থাকি। এইটা কালবৈশাখি। মাইধ্যে মাইধ্যে দূর থেইক্যা আইসা দূরে মিলাইয়া যায়।’
ভাদ্র -আশ্বিন মাসে বান তুফানে কি করেন ?
‘এই সময়টা বেশী খারাপ। তখন আমরা সাগরের শরীলটা শুঁইকা শুঁইকা চলি। ঊনতাইল্লা গরম পড়লে আমরা বুঝি বিপদ আইতাছে। ভাদ্র মাসের তের তারিখে শীতে খুঁটা গাড়ে। হেইদিন শীতে খুটা গাড়ি কয় - আমি আইতে আছি, তোরা সব খেঁতা বাইর কর। হেই সময় মাইধ্যে মাইধ্যে রাইতে খুব কুয়াশা পড়ে। আবার দিনে পড়ে ঠান্ডা ভাঙা কড়া রইদ। রাইতে শীত,দিনে গরম। আমরা সাবধানে চলি। আবার মাইধ্যে মাইধ্যে দেখি কি - শীত শুরুর আগে উত্তর দিক থেইক্যা গন্ডায় গন্ডায় পাখি দক্ষিনে উড়াল দিতাছে। হেই সময় হঠাৎ করি যদি দেখি, পাখিগুলান আবার উত্তরে উইড়া আইতাছে,তখন আমরা চিন্তায় পড়ি ! কারন পাখিগুলাইন তো এখন আসার কথা নয়। ওরা তো ফিরা যাইবো শীতের পরে। তখন আমরা বুঝি, দক্ষিন দিক থেইক্যা কোন বিপদ আইতাছে। সাগর ফুইলতাছে। আমরা গাঙ্গের তুন কুলে চইলা আসি। আবার আকাশের ভাব দেইখাও মন খোলাশা হইয়া যায়।
সে কি রকম?
‘এই ধরেন, আমাদের সাগরের মুখটা হইল দক্ষিণ পূর্বমুখী। মাঝে মাঝে পূর্ব-দক্ষিণ দিক থেইক্যা কালা মেঘ ধরে। সেটা খুব বিপদ। মাইধ্যে মাইধ্যে এইটা কাইটাও যায় ।
‘সেটা কেমনে কাটে?
‘এই ধরেন, পূর্বে কালা মেঘ ধইরলো। হেই সময় আবার পশ্চিমেও কালা মেঘ আর একটা বাসা বাঁইধলো।
সেটা কি করে!
উইড়া পূর্ব দিকে আইসতে থাকে। আবার পূবেরটাও পশ্চিমে আইসতে থাকে। উপরে আসমানে তারা গুতাগুতি শুরু কইরা দেয়। উপরে উপরে তখন দুইজনে রফা হইয়া যায়, নিষ্পত্তি হয়। এই রকম দুই দিকে যখন কালা মেঘ ধরে, আমরা কই-কিছু হইত না, বিপদ নাই’।
সাগরে ছুটে যাওয়ার জন্য জাহাঙ্গীর মাঝি ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এক বিরহী রসিক যেমন তার প্রিয়তমার জন্য উতলা হয়ে ওঠে, জাহাঙ্গীরের ভেতরেও তেমন করে চষ্ণলতা ফুটে ওঠে। জাহাঙ্গীর মাঝি বলে ওঠে-
‘মাইনসের শরীলের থুন যেমন ঘামের গন্ধ কয়, সাগরের শরীলের থুনও ঘামের গন্ধ কয়। সেই ঘামের গন্ধ শুইক্যা আমরা চলি’।
শুধু জাহাঙ্গীর মাঝি নয়। মেঘনার তীরের আঁতর আলী মাঝি, রহমত মাঝি, সোলায়মান মাঝি-এদের সবারই সাগরের সঙ্গে বেড়ে ওঠা। সাগরই ওদের জীবন মরণ। ওদের একজনের হাতে ছোট্ট এক ব্যান্ডের রেডিএকটানা বেজে যাচ্ছিল সেটি। সাগর গরম হলে তো রেডিওতে বলে। শুনেন না?
‘ওটা তো যন্ত্রের বাক্স, যন্ত্রে কথা কয়। আমরা থাকি সাগরের কইলজার মইধ্যে, সাগরের নাড়ি ধইরা সাগরের ভাষা বুঝি। সাগরের কইলজায় কান রাইখ্যা সাগরের গান শুনি।’