তৃণমূলের তথ্য এবং তথ্যের সরলিকরণ
তথ্যের অবাধ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আমরা পুর্বের চেয়ে অনেক বেশী সোচ্চার। আধুনিক বিশ্বে মনে করা হয় তথ্যই শক্তি। যার মানে দাঁড়ায়, যার যত বেশী তথ্য ভান্ডার আছে সে ততবেশী শক্তিশালী বা ক্ষমতাবান। এ ধারনা থেকে দ্রুততম সময়ে তথ্য পাওয়ার আকাংখা থেকে মানুষ নির্ভর করছে ইন্টারনেট, প্রযুক্তি, গণমাধ্যম ইত্যাদির উপর। এই সকল যান্ত্রিক ও প্রকৃয়াজাত মাধ্যম গুলো তথ্যের দ্রুতলয়ের চলয়মানতা নিশ্চিত করে। উন্নত বিশ্বের সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ তথ্য প্রযুক্তির সাথে দ্রুততার সাথে সংযুক্ত হচ্চেছ। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের এই বাংলাদেশে এখনো এর প্রসার তেমন ঘটেনি। আমাদের সনাতন গ্রামগুলোতে এখনো তথ্য প্রবাহের অবাধ যাতায়াত নেই। তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ নানান সনাতন মাধ্যমের উপর নির্ভর করে । সনাতন জ্ঞান লোকায়ত জ্ঞান ইত্যাদির উপর গ্রামীণ জনগন অনেকটাই নির্ভরশীল। তথ্যকে অন্য অর্থে বলা যায় জ্ঞান। তথ্যই জ্ঞান। কিন্তু সকল জ্ঞানই তথ্য নির্ভর নয়। গ্রামের মানুষ অনেক ক্ষেত্রে নানান কারনে কুসংস্কারে বিশ্বাসী হয়ে উঠে। এই কুসংস্কার জ্ঞানও বটে। তবে তথ্য সর্বস্ব নয়। তাহলে বুঝা যায় জ্ঞান মানেই তথ্য নয়। সঠিক যাচাই করা খাঁটি তথ্যই জ্ঞান। তাহলে সঠিক তথ্য আমরা কিভাবে পাব? তার কষ্টিপাথরই বা কি? যেখানে প্রযুক্তি পৌঁছেনি। গণমাধ্যম যেখানে নেই, সেখানে মানুষ কিভাবে তথ্য পেয়ে থাকে। প্রান্তিক মানুষেরওতো প্রচুর তথ্যের প্রয়োজন থাকে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ নানান তথ্যের উপর নির্ভর করে। শহরের মানুষ নানান সুযোগ সুবিধার মধ্যে বাস করে। তাদের তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ ও বেশী। কিন্তু গ্রামের মানুষ তা পায়না। তাদের অনেক সময় তথ্য বিভ্রান্তের মধ্যেও পড়তে হয়। এই বিভ্রান্তির ফলে মানুষের শুধু উন্নতিরই ব্যাঘাত ঘটে না, অনেক গ্রামীণ জীবনেও ভোগান্তির সৃষ্টি হয়। তথ্য গোপনীয়তা শুধু সরকারের মধ্যে বিরাজমান নয়। এ প্রবণতা সংবাদ মাধ্যম সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, সমাজ গোষ্ঠী ব্যক্তির মধ্যেও দেখা যায়। অনেকে সংকীর্ন স্বার্থ হাসিলের জন্য তথ্য গোপনীয়তা সহ তথ্য বিকৃতির ও আশ্রয় নেয়। রাষ্ট্র থেকে তৃণমুল পর্যন্ত এ প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সাধারন ভাবে তথ্য আধিকারের কথা যখন আমরা বলি তখন এর আওতায় শুধু সেই সব তথ্যকেই বুঝি, যেগুলো সরকারের ক্ষমতা খর্ব হবার ভয়ে জনগনের কাছ থেকে গোপন রাখতে চায়। জনগনকে জানতে দিতে চায়না। এগুলো দুর্বল সরকারের ইঙ্গিত। দেখা যায় তথ্য আধিকারের সঙ্গে সরকারের একটি সম্পর্ক রয়েছে। পরাশক্তি গুলোও নানা ভাবে তথ্য গোপন ও বিকৃত করে থাকে। ইরাক আগ্রাসনের আগে বুশ সরকার নির্লজ্জ ভাবে ইরাক সংক্রান্ত অনেক তথ্য বিকৃত ও গোপন করে। যা এখন সারা বিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠেছে। আবার গ্রামের অনেক চতুর মানুষ তথ্য গোপন ও বিকৃত করে তার কর্ম হাসিল করে। তথ্য বিভ্রাটের ফলে গ্রামের মানুষ প্রায়ই প্রতারিত হয়। বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়টি গ্রামীণ সমাজে অত্যান্ত স্পর্শকাতর বিষয়। এর জন্য তাদের বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ঘটকের শরনাপন্ন হতে হয়। গ্রামীন সমাজে অনেক প্রফেশনাল ঘটকও আছেন। শখের বসেও অনেকে ঘটকের কাজ করেন। এরা বিয়ের উকিল বলেও পরিচিত। এদের কাজ হলো কি করে বিয়ে ঘটানো যায়। এর জন্য তথ্যের হেরফের, গোপনীয়তা, অতিরঞ্জন সব কিছুই করে থাকেন। সম্প্রতি নোয়াখালীর জাহানাবাজ গ্রামের আবদুর রাজ্জাক নামের এক যুবক বিয়ে করে। ঘটকের মাধ্যমে তার সব তথ্য সরবরাহ করা হয়। আবদুর রাজ্জাকের আত্মীয় স্বজন কনের তথ্য সংগ্রহ করে। একদিন কনে দেখেও আসে। বিয়ের পর বরপক্ষ মহাক্ষ্যাপা । জানাগেলো যে মেয়েকে কনে পক্ষ দেখিয়েছে এই কনে সে মেয়ে নয়। ঘটক বলেছিলো কনে অষ্টম শ্রেণী পাশ করেছিল, কিন্তু আদৌ মেয়েটি কোন পড়ালেখা করেনি। তথ্য বিভ্রাটে পড়ে বরপক্ষ মহা অসন্তু'ষ্ট। ফলে একটা সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এ রকম ঘটনা গ্রামঞ্চলে অহরহই ঘটে থাকে। তথ্য আবশ্যই হতে হবে সত্য, বস্তুনিষ্ঠ। সকল ধর্মেরই একটা সাধারণ বাণী হচ্চেছ, ‘সদা সত্য কথা বলিবে’। অর্থাৎ সদা সঠিক তথ্য পরিবেশন করিবে। মিথ্যা বলা মহা পাপ । মানে দাঁড়ায় মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করলে শাস্তি ভোগ করতে হবে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও আমরা সকল সময় সঠিক তথ্য পরিবেশন করতে চাই না। আমাদের জন্ম নিবন্ধন, আয়ব্যয়, সম্পদ সর্বেক্ষেত্রেই আমরা তথ্যের লুকোচুরি করে ফেলি। গ্রামীন হাট বাজারগুলোতে কেনা বেচার সময় তথ্যের উপর নির্ভর করে বাজার সদাই করেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তথ্য যাচাইয়ের পন্থাও খুব মজার। গ্রামের গরুর হাটে গিয়ে দেখেছি যারা দুধের গাভী বা হালের বলদ কিনতে চান তারা বিক্রেতার কাছে নানান প্রশ্ন করে তথ্য জানতে চান। হালের বলদ কিনতে এরা জানতে চান । এটি কোন এলাকার গরু , আকার, রঙ, কয়টি দাঁত পড়েছে, গরুর গোবরের গন্ধ কেমন, রঙ কেমন, ইত্যাদি ইত্যাদি। গাভী কিনতে তথ্য জানতে চান, মা গাভী কত কেজি দুধ দিতো, কয়বার বাচ্চা দিয়েছে, বয়স কেমন, গাভীর রঙ আকারতো আছেই । ক্রেতার পছন্দমত সব তথ্য মিলে গেলে তবে বেচা বিক্রি করার পালা। দেখা যায় আমাদের জীবন যাপন কি শহরের কি গ্রামে সর্বাঙ্গীন ভাবে তথ্যের উপরই নির্ভর করতে হয়। তথ্য যত স্বচ্ছ হবে আমাদের যাপিত জীবন ও তত নির্ঝঞ্ঝাট হবে। নিত্যদিনের ক্রিয়াকর্মে তথ্যের আদান প্রদানে সতর্ক থাকলে আমাদের সমষ্টিক পথ অনেক মসৃন হবে। একটি অন্যন্য জাতি হিসাবেও আমরা পরিগণিত হতে পারি। তাহলে এর জন্য আমাদের করনীয় কি ! ব্যক্তি জীবনেও এর জন্য আমাদের পরিশীলিত ও ঋদ্ধ হতে হবে। তথ্য হীনতা ও বিকারগ্রস্ত তথ্যের কারনে সমাজ অসঙ্গতি অজ্ঞানতার গ্রাসে নিমজ্জিত হয়। গ্রামীণ দুর্বল তথ্যপ্রবাহের কারনে শাসক শ্রেণী ও লুটেরা কিছু স্বার্থান্বেষীমহল বিকৃত ও ভুল তথ্য সরবরাহ করে দেয়। ‘বোকার ধান পোকায় খায়’ বলে ব্যপক ভাবে গ্রামীণ চাষীদের কাছে তথ্য প্রচার করে ক্ষতিকর কীটনাশকের রমরমা ব্যবসা করে যাচ্ছে বহুজাতিক প্রাণ হত্যাকারী কীটনাশক কোম্পানীগুলো। ফলশ্রুতিতে আমাদের প্রাণবৈচিত্র ধ্বংস হচ্ছে। অধিক খাদ্য উৎপাদনের তথ্য প্রচার করে জেনেটিক ফসল বা কৃত্রিমভাবে আবিস্কৃত স্বর্ণালী ধান আমাদের দেশে প্রচলন করে ফায়দা লুটে নিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে কৃষকদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বিখ্যাত সব স্থানীয় প্রজাতির নানান ধরনের জাত। হারিয়ে যেতে বসছে তাদের ঘরে ঘরে বীজ সংরণের সনাতন জ্ঞান। তাই আমাদের এ দিকেও নজর রাখা দরকার কে কি কোন উদ্দেশ্যে তথ্য সরবরাহ করছে, তার দিকে যেমন খেয়াল রাখা দরকার, ভুল বিভ্রান্তিকর উদ্দেশ্য প্রণোদিত তিকর তথ্যের প্রতিও আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার ।