স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা #### মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

নোয়াখালীর সেচ প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে



নোয়াখালীর সেচ প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

ভাটির দেশ হিসাবে পরিচিত বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা পলিমাটি বিধৌত উর্বর কৃষি প্রধান এলাকা। এ উর্বর ভূমিকে সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগিয়ে কৃষি উৎপাদনে কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ আজ অবধি কেউ গ্রহণ করেনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় এ লক্ষ্যে কয়েকটি সেচ প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হলেও আজও সেগুলো তিমিরেই বন্দী হয়ে আছে। বিভিন্ন সরকারের আমলে দফায় দফায় নানান আশ্বাস দিলেও আজ পর্যন্ত নোয়াখালী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের ৩৭০ বর্গমাইল এলাকা সেচ সুবিধা পাবে এবং প্রতি বছর ৫০ হাজার টন অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন সম্ভব হবে বলে পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী এ পর্যন্ত হিসাবে টাকার অঙ্কে যা দাঁড়ায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকারও বেশী। এ এলাকার মূল ভূ-খন্ডকে রার জন্য লক্ষীপুরের চর রমনীমোহনে মেঘনা নদীর মোহনায় রহমতখালী খালের উপর রেগুলেটর তৈরী করা হয় ১৯৭২ সালে। রেগুলেটরের সাহায্যে প্রয়োজন মত পানি বের করা যায়। কিন্তু মেঘনার পানি খালে প্রবেশ করার সুযোগ নেই।
বর্তমানে মেঘনা নদীতে লবণাক্ততা নেই। কিন্তু রেগুলেটরের সাহায্যে খালে পানি প্রবেশের ব্যবস্থা না থাকায় শুকনো মৌসুমে নোয়াখালী ও লীপুর জেলায় সেচের জন্য পানি সংকট দেখা দেয়। এজন্য রহমতখালী রেগুলেটরে একটি 'নেভিগেশন লক গেইট’ নির্মাণ এবং কামতা খালের উপর একটি পাম্প হাউজ নির্মাণ করলে শুকনো মৌসুমে ৯২ হাজার একর জমিতে সেচ সুবিধা পাবে। এ প্রকল্পটি সেচ, পানি উন্নয়ন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন। কামতাখালের উপর পাম্প হাউস নির্মিত হলে ডাকাতিয়া নদীর পানি খালের মাধ্যমে ডাবল লিফটিং পদ্ধতিতে পাম্পের সাহায্যে প্রকল্প এলাকায় প্রবেশ করানো সম্ভব হবে। বিগত সব সরকার প্রধানরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন সময় এই সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দিলেও আজ পর্যন্ত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কোন লক্ষণ দেখা যায়নি।
এখনো একটি সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দূর্ভোগ মোচনের প্রহর গুনে যাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ভাটি অঞ্চলের ৪০ লাখেরও অধিক মানুষ। ৫০ বছর ধরে সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের অভাবে এলাকাবাসীর ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। বঞ্চিত হয়েছে বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লার ৪০ লাখেরও অধিক মানুষ। জলাবদ্ধতার নির্মম দুর্ভোগের কারণে এ অঞ্চলে কৃষি ও শিল্প খাতে ব্যাপক কোন উন্নতি হয়নি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার এর কাজ শুরু করে। এর জন্য প্রাথমিক কাজ শুরুর জন্য টাকা বরাদ্দও হয়েছিল কিন্তু পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের সরকারগুলো মানুষের দাবির মুখে বেশ কয়েকবার কাজ শুরুর প্রক্রিয়া দেখালোও অজানা কারণে মাঝপথে ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে। বিভিন্ন সময়ে এর বিভিন্ন নামও দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর কোন কাজই হয়নি।
১৯৮০-৮১ সালে কামতা ও মজনাঘাট রেগুলেটর তৈরীর মাধ্যমে এলাকায় সেচ উন্নয়নের জন্য লীপুরের একটি পানি উন্নয়ন বিভাগীয় দফতর চালু করা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের কোন অর্থবহ ভূমিকা নেই। নাম পরিবর্তন করে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা জরিপের অজুহাতে স্বাভাবিক নিষ্কাশন ব্যবস্থায় খাদ্য কর্মসূচীর আওতায় যে সামান্য কিছু কাজ হাতে নেয়া হয়েছিলো তাও এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত চালু প্রকল্পগুলোর চেয়ে উক্ত প্রকল্পের এলাকাটির সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ঢাকা থেকে ৭০/৮০ কিলোমিটার ভাটিতে দেশের দণি-পূর্বাঞ্চলীয় বিস্তৃত মেঘনা নদী বিধৌত ও বঙ্গোপসাগরের মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত ব-দ্বীপমালা নিয়ে এ প্রকল্পটি তৈরী করা হয়। বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার ৪০ লাখেরও বেশী অধিবাসী এ অঞ্চলে বাস করে। এরা অধিকাংশই কৃষিজীবি। মেঘনা ও সাগর বিধৌত এ অঞ্চলের ভূমি অত্যন্ত উর্বর। পলি মাটি সমৃদ্ধ এ উর্বর অঞ্চলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি ফসল ফলে। পূর্বে মুহূরী সেচ প্রকল্প, পশ্চিমে চাঁদপুর সেচ প্রকল্প, দক্ষিণে উপকূলীয় বাঁধ বেষ্টিত এলাকার চাষাবাদ এবং বসবাসযোগ্য ভূমির পরিমাণ প্রায় ছয় লাখ একর। জলাবদ্ধতা এবং বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস এ অঞ্চরের মানুষের অন্যতম সমস্যা। এ জন্য বাংলাদেশের দণি পূর্বাঞ্চলের ৪০ লাখের বেশী লোক দুর্ভোগ মোচনের প্রহর গুনছে এ সেচ প্রকল্প প্রত্য করার জন্য।
চৌমুহনীর অনেক সড়ক পথে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে, সড়ক পথে মাল পরিবহনের খরচ অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে। এর কারণে এই নৌপথের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু একশ্রেণীর অবৈধ ব্যবসায়ী খালের দিকে তাদের ঘরগুলো সম্প্রসারণ করে পরিবহনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাব কেন্দ্রের সঙ্গে এই বিশাল অঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকার নৌযোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। যার কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা কেন্দ্রটির অস্তিত্ব মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। অন্যদিকে খালের উপর অবৈধভাবে দোকানপাট নির্মাণ এবং খালের উপর ছোট ছোট নীচু পোল নির্মাণসহ কোথাও কোথাও পানি চলাচল বন্ধ করে রাস্তা নির্মাণের কারণে বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশন দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে এ বিশাল এলাকার নিম্নাঞ্চলে প্লাবন দেখা দিচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রাস্তাঘাট। প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার একর জমির ফসল। চৌমুহনী বড় পুল এলাকাটি তিনটি খালের সংযোগস্থলে অবস্থিত। পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে চৌমুহনী-ফেণী খাল এবং উত্তরে চৌমুহনী- ছাতারপাইয়া খাল এবং দক্ষিণে নোয়াখালী খাল। এই তিনটি খাল হচ্ছে বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। এই তিনটি খালের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে অসংখ্য শাখা খালের। বর্ষা মৌসুমে ফেনীসহ নোয়াখালীর পূর্বাঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের চাপ পড়ে উক্ত খালগুলোর উপর। উক্ত খালগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে লক্ষীপুরের রহমতখালী খালের। আবার রহমতখালী খালের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ রয়েছে মেঘনার সঙ্গে। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ খালগুলো অর্থাৎ ফেনী-চৌমুহনী-ছাতারপাইয়া ও চৌমুহনী-নোয়াখালী খাল ভরাট করে অবৈধভাবে দোকানপাট বাড়িঘর গড়ে উঠেছে। ফলে ফেনী ও ছাতারপাইয়ার পানির চাপে বর্ষা মৌসুমে বেগমগঞ্জ ও সেনবাগ ডুবে যায়। ডুবে যায় হাজার হাজার একর জমির ফসল, বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট।
চৌমুহনী, ফেনী খালের পাশ দিয়ে চলে গেছে চৌমুহনী ফেনী সড়ক। কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি সেই খাল ভরাট করে খালের উপর পুল ও ইটভাটার রাস্তা করার কারণে চৌমুহনীর সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের নৌযোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সোনাইমুড়ি থেকে চাটখিল রামগঞ্জ হয়ে মহেন্দ্র খালটির সংযোগ রয়েছে মেঘনার শাখা নদী ডাকাতিয়ার সাথে। এ শাখা খাল গুলোর জলপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে এবং সেচ সুবিধা বাড়ানোর লক্ষ্যে ‘নর্থ-সাউথ ইরিগেশান প্রজেক্ট’ নামে স্বাধীনতার পর একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিলো। সে প্রকল্পটিও আজও আলোর মুখ দেখেনি।
একসময় চৌমুহনীর মত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাকেন্দ্রের সঙ্গে সড়ক পথে যোগাযোগ ছাড়াও নৌ যোগাযোগের সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। নৌপথে খরচ কম ও নানান সুবিধার কারণে ব্যবসায়ীরা সাধারণত নৌপথেই মালামাল পরিবহনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কিন্তু খালের অকার্যকরণের ফলে নৌপথ ব্যবহার বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এখন এই অবৈধ বাড়ীঘর ও খালের উপর রাস্তা অপসারণ করে নৌ চলাচলের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা গেলে চৌমুহনীসহ এ অঞ্চলের ব্যবসা কেন্দ্র গুলো চাঙ্গা হয়ে উঠবে। উপকৃত হবে নিম্নাঞ্চলের লাখ লাখ কৃষক, রক্ষা পাবে হাজার হাজার একর জমির ফসলা। প্রতিবছর সংস্কার করতে হবে না হাজার হাজার কিলোমিটার রাস্তাঘাট। এ ব্যাপারে জনগণ সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপরে কাছে অসংখ্যবার আবেদন নিবেদন করলেও কোনো কার্যকর ফল পাওয়া যায়নি।

মুষ্টিচাল মহিলা সমিতি, ষ্টাডি

মুষ্টিচাল মহিলা সমিতি, ষ্টাডি

মাহমুদুল হক ফয়েজ

মুষ্টিচাল সমিতির পুরো নাম, ‘মুষ্টিচাল মহিলা সমিতি, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালি’। নোয়াখালি জেলার বেগমগঞ্জ থানার একলাশপুর ইউনিয়নের একলাশপুর গ্রামে কিছু গৃহবধুর নিজস্ব জ্ঞান বুদ্ধিতে গড়ে ওঠা এই সমিতি তাঁদের ঐকান্তিক ইচ্ছার ফসল । নানান প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে এই নারীরা নীরবে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছেন। এই সমিতি থেকে আমাদের মূল শিণীয় হল, গ্রাম-বাংলার জনসমাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নিজস্ব জ্ঞান ও প্রথাকে সহায়ক পরিবেশের মাধ্যমে পরিচর্যা করলে নারীরা নিজেরাই বিকশিত হতে পারেন, এসব জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে অতি ুদ্র প্রচেষ্টার মাধ্যমেও তাঁরা স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করতে পারেন, চেষ্টা নিয়ে থাকেন।

স্টাডিটি যেভাবে করা হয়েছে
মুষ্টিচাল সমিতি নিয়ে প্রথমে প্রকল্পের জন্য প্রতিবেদন করেছিলাম। এরপর স্টাডিটি করতে যেয়ে সমিতির সদস্যদের সাথে নিবিড়ভাবে কথা বলতে গেলে মনে হয় যে এ কাজটি মেয়েদের দিয়েই ভালো হবে, মেয়ে তথ্য সংগ্রাহকের কাছে সমিতির সদস্যরা মন খুলে কথা বলবেন। তাই পূর্ব যোগাযোগের সূত্রে মাস লাইন মিডিয়া সেন্টার (এমএমসি)-এর পাঁচজন তৃণমূল নারী সংবাদকর্মীর সাথে কথা বলি, তাঁরা কাজটিতে বেশ আগ্রহ বোধ করেন এবং স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতে রাজী হন। ২২ অক্টোবর ২০০৩ এই দলটি একলাশপুর গ্রামে গিয়ে স্টাডিটি শুরু করেন। পাঁচজন সংবাদকর্মী পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রথমে মুষ্টিচাল মহিলা সমিতির সদস্যদের সাথে পৃথক পৃথকভাবে আলাপ করেন এবং মূলত অংশগ্রহণমূলক আলোচনার ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ করেন।

এরপর সংবাদকর্মীরা এলাকার অন্যান্য মানুষদের সাথে আলোচনা করে এলাকা সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা নেন। এরপর প্রতিটি সংবাদকর্মীর সংগৃহীত তথ্য এক জায়গায় এনে প্রাথমিক রিপোর্টটি তৈরি করা হয়।

স্টাডিটির পরবর্তী পর্যায়ের জন্য এই দলেরই দুজন স্বেচ্ছাসেবী সংবাদকর্মীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে স্টাডিটি কীভাবে করা যায় সে ব্যাপারে গবেষণা তত্ত্বাবধানকারী তাঁদের সাথে আলাপ করেন। পুরো স্টাডিটি শেষ করতে তিন মাস সময় লেগেছে।

স্বেচ্ছাসেবী সংবাদকর্মীরা হলেন: ১. খালেদা আক্তার লাবনী ২. সাজিয়া ফেরদৌস পান্না ৩. শাহনেওয়াজ সারওয়ার দিনা ৪. নাজনীন সুলতানা এবং ৫. আয়শা আক্তার হেলেন।

এই প্রতিবেদনের তথ্যগুলো মূলত অক্টোবর ২০০৩ থেকে জানুয়ারি ২০০৪ সময়কালে সংগৃহিত হলেও কিছু কিছু েেত্র এপ্রিল ২০০৫-এ প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করার সময় নাগাদ পরিবর্তনের কথা সংযোজিত হয়েছে। এই সংযোজন/সংশোধনগুলোর সাথে সেটা উল্লেখ করা আছে। এ ছাড়া আঞ্চলিক সমন্বয়কারী যাচাইপর্বে , যে পর্যবেণগুলো করেছেন তা মূল প্রতিবেদনে সন্নিবেশিত হয়েছে আবার আলাদা সংযোজনী হিসেবেও রাখা হয়েছে।

গবেষণার সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রোপট
নোয়াখালী একটি ঘনবসতি জেলা। সমগ্র জেলাটি একটি কৃষিপ্রধান এলাকা। এর প্রধান অর্থকরী ফসল ধান। জেলার অধিকাংশ মানুষ কৃষক, এর মধ্যে বিত্তহীন, অত্যন্ত দরিদ্র মানুষের সংখ্যাই বেশি। কৃষিকাজ ছাড়াও অনেকে অন্যান্য নানান কাজ করে থাকেন। গ্রামাঞ্চলের মানুষের একটি বড় অংশ দিনমজুরির ওপর ভিত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

একলাশপুর গ্রামটি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার ১৭ নং একলাশপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত। একলাশপুর ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের একটি একলাশপুর গ্রাম। মুষ্টিচাল সমিতি গড়ে উঠেছে একলাশপুর গ্রামের দালানবাড়ি এলাকায়, যা একলাশপুর গ্রামের পূর্ব অঞ্চলের অন্তর্গত এবং জেলা শহর মাইজদির খুব কাছে। এই এলাকার বিভিন্ন জন আলাপ-আলোচনায় মূলত আনুমানিক হিসাব করেই বলেছেন যে দালানবাড়ি এলাকায় আনুমানিক পাঁচ থেকে ছয় হাজার মানুষ বসবাস করছেন (২০০৩ সালের শেষের দিকে)।

ব্রিটিশ আমলে এখানে নির্মিত হয় সরলাদেবী বালিকা বিদ্যালয়, এর বিদ্যালয় ভবনটি ছিল পূর্ব একলাশপুর এলাকার মধ্যে ইটের তৈরি একমাত্র পাকা দালান। স্কুলটি প্রথমে জুনিয়র স্কুল হলেও পরে এটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয় এবং নাম পাল্টে পূর্ব একলাশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রাখা হয়স্কুলটির বর্তমান নাম এটাই। ভবনটিকে ধরে গ্রামের মানুষ এলাকার পরিচয় দিতেন, সেই থেকে এলাকার নাম দালানবাড়ি। এ গ্রামের পূর্ব পাশ ঘেঁষে চলে গেছে নোয়াখালি-লাকসাম রেললাইন। এই রেললাইনের দুই কিলোমিটার দেিণ মাইজদি রেলষ্টেশন এবং সাত কিলোমিটার উত্তরে চৌমুহনী রেলষ্টেশন। চৌমুহনী বাজারটি নোয়াখালির বৃহত্তম বাণিজ্যিক কেন্দ্র। সরিষার তেলের ঘানির জন্য এ বাজারটি পুরো দেশে প্রসিদ্ধ। দালানবাড়ি থেকে নোয়াখালির মূল শহর মাইজদি কোর্ট প্রায় চার কিলোমিটার দেিণ।

নোয়াখালির গ্রামীণ জনপদে ধর্মীয় প্রভাব ব্যাপক। সমাজে যুগ যুগ ধরে নানা সংস্কারের প্রচলন। গ্রামাঞ্চলে পর্দার প্রচলন এখনো ব্যাপক। গ্রামীণ নারীরা সহজে ঘরের বাইরের কাজে যান না। দুএকজন শিতি নারী এ প্রথার বাইরে আসার চেষ্টা করলেও এর ব্যাপক কোনো আবেদন সৃষ্টি হয়নি। এ গ্রামে সরকারি-বেসরকারি কোনো উন্নয়ন কাজ বেশি আকারে হয়নি। এলাকার পাশেই আছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি যার কথা ইতিমধ্যে বলা হয়েছে, আর আছে একটি সরকারি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, এটি স্থাপিত হয়েছে আশির দশকের শেষ দিকে। গত কয়েক বছর ধরে সেখানে ডাক্তার নিয়মিত বসেন না, যদিও নিয়মিত ডাক্তার থাকার কথা। এলাকাবাসী অনেকে জানান কেন্দ্রটিতে ডাক্তার সকাল এগারটার দিকে এসে দুপুর দেড়টা-দুটোর দিকে চলে যান। একলাশপুর হাইস্কুল দালানবাড়ি থেকে দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে যেখানে গ্রামের প্রাইমারি-পরবর্তী ছেলেমেয়েরা যায়। এছাড়া ঐ হাইস্কুলের পাশেই আছে মাদ্রাসা, গ্রামের কিছু পড়–য়া সেখানেও যায়।

একলাশপুর গ্রামে অধিকাংশ ব্যক্তির পেশা কৃষি, তবে অনেকেই বিভিন্ন কলকারখানাতেও কাজ করেন। একলাশপুর গ্রাম এবং এর আশেপাশের এলাকার জমিগুলো মূলত এক ফসলী। জ্যৈষ্ঠ থেকে কার্তিক পর্যন্ত জমি সাধারণত পানির তলায় থাকে, ফসল হয় না, ফলে ঐ সময়টা কৃষিমজুরির কাজ খুব একটা থাকে না। বছরের একটা বড় সময় কাজ না থাকায় নোয়াখালীর অন্যান্য এলাকার মতোই দালানবাড়ি এলাকার অধিবাসীদের একটি ব্যাপক অংশ অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায় দিন কাটান। এলাকায় পুরুষ শ্রমিকের দিনে মজুরি গড়ে ১০০ টাকা, ব্যস্ত সময়ে যখন মজুর পাওয়া যায় না তখন মজুরি আরো খানিকটা বেড়ে যায়। ২০০৫-এর ফসল কাটা-মাড়াইয়ের মৌসুমে একজন পুরুষ শ্রমিক সূর্য ওঠা থেকে মাগরিবের আজান পর্যন্ত কাজ করার জন্য ১২০ টাকা বা এর কিছু ওপরও পেয়ে থাকেন, এর সাথে থাকে তিন বেলা ভাত ও চা-নাস্তা। মাটি কাটার জন্য মৌসুমে পুরুষ শ্রমিক ১৫০ টাকা পেয়ে থাকেন।

দালানবাড়ি এলাকার নারীরা মূলত: গৃহিনী। এখানে মেয়েরা দেশের অন্যান্য অনেক এলাকার মেয়েরা যেভাবে মজুরি শ্রমিক হিসাবে েেত-খামারে বা অন্যান্য পেশায় কাজ করেন তেমনভাবে কাজ করেন না। দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা সাধারণত অন্যের বাড়িতে ফাইফরমাশ খাটেন যার বিনিময়ে কোনো নির্দিষ্ট হারে আর্থিক মজুরি পান না। তাঁরা তিনবেলা খাবার এবং চাল পেয়ে থাকেন। চালের পরিমাণ নির্ভর করে কাজের ধরনের ওপর এবং গৃহস্থ কতটা অবস্থাপন্ন তার ওপর। একলাশপুর গ্রামের উত্তর দিকে একলাশপুর বাজার থেকে এক দেড় কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে গ্লোব বিস্কুট ফ্যাক্টরি এবং গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালসের ওষুধ কারখানা যেখানে গ্রামের নারী-পুরুষ শ্রমিক কাজ করেন। এলাকার অধিবাসী সাংবাদিক মহিউদ্দিন নসু জানান ইউনিয়ন উইমেন ডেভেলপমেন্ট সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠান , গ্রামের বেশ কিছু মহিলাকে বাঁশ-বেতের সরঞ্জাম ও অন্যান্য হাতের কাজে প্রশিণ দিয়েছিল। এখন সেইসব মহিলাদের মধ্যে কয়েকজন মোড়া, চালুনি, ডালা ইত্যাদি তৈরি করেন যা বাড়িতে এসে ক্রেতারা কিনে নিয়ে যান। এছাড়া কাছাকাছি হোটেলেও শ্রমিক হিসাবে কিছু নারী কাজ করে থাকেন।
এলাকায় গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা, স্বনির্ভর বাংলাদেশ, কোডেক ইত্যাদি স্থানীয় ও জাতীয় এনজিওগুলো কাজ করছে। একলাশপুর গ্রামটিতে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে।

দারিদ্র্য ও নিদারুণ পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্যেই এখানে নারীরা সংসারে নিজস্ব সৃজনশীলতা যোগ করতে সচেষ্ট, তাঁদের সেই চেষ্টা দিয়ে সংসারকে টিকিয়ে রাখেন, সামনে এগিয়ে নিয়ে যান। এই চিত্র হয়তো দেশের অন্যান্য এলাকায় বাঙালি সমাজের সর্বত্র কমবেশি একই রকম।

গ্রামীণ সমাজে নারীদের এই সৃজনশীলতার একটি দৃষ্টান্ত প্রতিবেলার রান্নার চাল থেকে এক মুঠো তুলে রাখা, ঘরে চাল যখন বাড়ন্ত, স্বামী যখন খাবারের যোগান দিতে পারছেন না, গৃহিনী তখন দুর্দিনের সেই সম্বল বের করেন স্বজন-সন্তানের মুখে আহার তুলে দিতে। মুষ্টিচাল, নোয়াখালিতে যার নাম ‘মুঠ-চাইলা,’ বাঙালি নারীর ঐতিহ্যবাহী প্রথা। শত শত বছরের এই প্রথাকে কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে কাজে লাগিয়ে দালানবাড়ির কিছু নারী স্বাবলম্বী হতে চেয়েছেন। মুষ্টিচাল জমিয়ে সেটা বিক্রি করে তাঁরা সপ্তাহে সপ্তাহে সমিতিতে সঞ্চয় জমা দিয়ে পুঁজি তৈরি করতে চেয়েছেন। তাঁদের এই চেষ্টাকে অনুসরণ করতেই এই স্টাডি।

যে জিজ্ঞাসাগুলো নিয়ে মুষ্টিচাল সমিতির কাছে গিয়েছি

স্টাডিটি করতে গিয়ে যে মূল জিজ্ঞাসা বা কৌতূহলগুলো নিয়ে আমরা মুষ্টিচাল সমিতির কাছে গিয়েছিলাম, সেগুলো এরকম:
ক্স দালানবাড়ি গ্রামের নারীরা কোন্ আর্থ-সামাজিক পোপটে মুষ্টিচাল মহিলা সমিতি গড়েছেন অর্থাৎ সমিতিতে কোন্ আর্থ-সামাজিক শ্রেণীর নারীরা সম্পৃক্ত হয়েছেন।
ক্স সমিতির সদস্যদের পারিবারিক আয় ও সম্পদের পরিমাণ কেমন
ক্স সমিতির সদস্যরা অন্য কোনো আয়মূলক কাজ করেন কি না
ক্স সমিতিটি করতে গিয়ে তাঁরা কী ধরনের ভাবনা, জ্ঞান ইত্যাদি কাজে লাগিয়েছেন
ক্স সমিতির সব সদস্য এর কার্যক্রমে সমানভাবে অংশ নিতে পারেন কি না
ক্স সমিতিতে আগে ছিলেন এখন নেই এমন সদস্যরা কেন চলে গেছেন
ক্স সমিতিতে জমানো টাকা দিয়ে সদস্যরা কী করেন
ক্স সমিতির সদস্যরা টাকা-পয়সার হিসাব কীভাবে রাখেন, কখনো টাকা-পয়সা নিয়ে বড় ধরনের কোনো গণ্ডগোল হয়েছে কি না
ক্স মুষ্টিচাল জমানোর মতো ধীর লয়ের কাজে এবং স্বল্প পুঁজি থেকে তাঁরা কতটুকু অর্জন করতে পারবেন বলে ভাবছেন
ক্স সমিতি নিয়ে এর সদস্যরা কী কী চিন্তাভাবনা করছেন।
ক্স সমিতিকে এগিয়ে নেয়ার েেত্র সদস্যদের পরিকল্পনা, চিন্তাভাবনা কী
ক্স সমিতিটির সরকারি নিবন্ধন হয়েছে কি না
ক্স সমিতির সদস্যরা পরিবারে কতটুকু মূল্যায়িত হন এবং পারিবারিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত বা মতামত কতখানি দিতে পারেন
ক্স সমিতির সদস্যরা সন্তানদের পড়ালেখা করান কি না বা এ ব্যাপারে কতটুকু সচেতন
ক্স সমিতির সদস্যরা স্বাস্থ্য ও সেনিটেশন বিষয়ে কতখানি সচেতন, স্যানিটারি ল্যাট্রিন বা অন্য কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করেন কি না
ক্স সমিতিটি করতে গিয়ে এর সদস্যরা পারিবারিক বা সামাজিক বাধার মুখোমুখি হয়েছিলেন কি না, হলে তা কী ধরনের বাধা ছিল, কীভাবে বাধাগুলো পেরিয়েছিলেন
ক্স সমিতি কোনো ধরনের রাজনৈতিক বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল কি না
ক্স সমাজের অন্যরা বিষয়টি কীভাবে দেখেছেন
ক্স দালানবাড়ি বা এর আশেপাশে মহিলারা বা (পুরুষ) মুষ্টিচাল মহিলা সমিতি থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন কি না, কেউ এ ধরনের কাজ শুরু করেছেন কি না

মুষ্টিচাল মহিলা সমিতি: উদ্যোক্তা শাহানা কবিরের কথা

মুষ্টিচাল সমিতির আদি উদ্যোক্তা শাহানা কবির। তিনি একলাশপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম মকবুল আহমেদের ভাতিজি। আত্মনির্ভর হওয়ার স্বপ্নটি শাহানা কবিরের মনে কোনো তাত্ত্বিক ধারণা থেকে আসেনি। নিজের জীবনের কঠোর বাস্তবতা থেকে তিনি উপলদ্ধি করেছিলেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ শাহানা কবিরকে বিয়ের কিছু দিনের মধ্যেই সংসারের পুরো দায়িত্ব নিতে হয়। তিনি চাকরি নেন মর্নিং সান কেজি স্কুল নামে একটি ছোট বিদ্যালয়ে। চাকরি নিলেও তাঁর স্বামীর পরিবার মূলত কৃষক পরিবার, সংসারের মূল আয়টি আসে সেখান থেকেই, শাহানাকে সেখানেও দায়িত্ব নিতে হয়েছে। তাঁর এক মেয়ে ও এক ছেলে। (২০০৫ সালে মেয়েটি মাস্টার্স দিচ্ছেন ও ছেলেটি দশম শ্রেণীর ছাত্র।)

শাহানার নিজের কথায়, ‘নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রয়োজন আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি। আমাদের এখানকার প্রায় প্রতিটি নারী স্বামীর সংসারের উপর এত বেশি নির্ভরশীল যে স্বামী ছাড়া ওদের আর কোনো আশ্রয় নেই। হঠাৎ করে সেই স্বামী যদি মারা যান কিংবা যদি তাঁর কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, অথবা স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যান তখন ওদের মানুষের করুণা ভিা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। আমি সব সব সময় ভাবতাম আত্মনির্ভর হবো।’

আত্মনির্ভর হওয়ার চিন্তা থেকেই তিনি স্থানীয় যুববন্ধন বহুমুখী সমবায় সমিতিতে যোগ দেন। শাহানা জানান এটি কোনো সংস্থার সাথে যুক্ত সমিতি না, এলাকার তরুণরা মিলে এই স্বনির্ভর সমিতিটি গড়ে তুলেছেন। এখান থেকেই তিনি ২০০০ সালের জুলাই মাসে এনজিও হাংগার প্রজেক্টের উজ্জীবক প্রশিণে অংশ নেন। নাঈমুজ্জামান মুক্তা, হাংগার প্রজেক্টের প্রাক্তন কর্মী যিনি উজ্জীবক প্রশিণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন, বলেন, “উজ্জীবক এমন একদল অনুপ্রাণিত ব্যক্তি যাঁরা আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে নিজের পাশাপাশি অন্যকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেন। উজ্জীবক প্রশিণ দেয়ার একটি মূল উদ্দেশ্য, প্রশিণের পর যাতে তাঁরা নিজের এলাকায় ফিরে গিয়ে নিজের সৃজনশীলতা, মেধা, দতা কাজে লাগিয়ে সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীলভাবে নিজের উন্নয়ন করতে পারেন এবং সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারেন।”

শাহানার কথায়: “হাংগার প্রজেক্টে প্রশিণ নিয়ে আমার মনের মধ্যে শক্তি আসলো। আমি এবার ভাবতে থাকলাম আমার এলাকার মহিলাদের নিয়ে কিছু করা যায় কিনা। ভাবতে ভাবতেই আমার মাথায় এলো মুষ্টিচাল নিয়ে কিছু করার কথা। প্রথমে আমার ঘরের চারপাশে যারা মহিলা আছে তাদের সাথে আলাপ করেছি। তাদের মধ্যে অনেকের কাছে ব্যাপারটা একটা খেলা খেলা মনে হয়েছিল। অনেকে এর গুরুত্বই বুঝতে পারেনি। তবে কেউ কেউ এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল। আবার কাউরে কাউরে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সমিতিতে এনেছি। আবার সমিতি করতে যারা রাজী হয়েছে, তারাই যারা প্রথমে এটার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি তাদেরকে বোঝাল। শুরু থেকেই অনেকেই আসা-যাওয়ার মধ্যে আছে। কেউ চলে যায় আবার কেউ আসে। কয়েকজন চলে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে। যাদের নিয়ে শুরু করেছিলাম তাদের মধ্যে বর্তমানে পাঁচ জন নাই (২০০৩ সালের অক্টোবর নাগাদ)।” বললেন শাহানা। এ প্রসঙ্গে এ কথাটি বলা দরকার, এখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মেয়েদেরকে সমিতি করে মুষ্টিচাল জমানোর পরামর্শ দিলেও বা অনেক নারী বিভিন্ন সূত্রে বিষয়টি জানার পর কয়েকজন একসাথে হয়ে মুষ্টিচাল জমালেও, শাহানা স্পষ্ট করেই বলেন যে সমিতি করে মুষ্টিচাল জমানোর ভাবনা তাঁর নিজেরই। তাঁর গ্রামে ও আশেপাশের এলাকায় মহিলারা রান্নার আগে মুঠিচাল উঠিয়ে রাখার বহু প্রাচীন প্রথাটি এখনো চালিয়ে আসছেন, চিরদিনের সেই অভ্যাসের মধ্যে বেড়ে ওঠা শাহানার মাথায় তাই এই ভাবনাটি আসাটা হয়তো প্রায় অবধারিতই ছিল।

২০০০ সালের জুলাই মাসে সমিতিটি শাহানার বাড়ির আশেপাশের ১০ জন মহিলা নিয়ে যাত্রা শুরু করে। হাংগার প্রজেক্টে প্রশিণ নেয়ার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে তাঁরা মুষ্টিচাল সমিতির কাজ শুরু করেন। তাঁরা ওই বছরের ১লা জুলাই দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমিতির যাত্রা শুরুর দিন হিসাবে চিহ্নিত করেন। তারপর বাড়তে বাড়তে সদস্য সংখ্যা ২৯-এ উন্নীত হয় । মাসদুই পরে চাল-বিক্রি করে সঞ্চিত পুঁজি যুববন্ধন সমিতির পুঁজির সাথে যোগ করে তাঁরা যৌথভাবে স্যানিটারি পায়খানার রিং বানানোর কাজে নামেন। কাজ দেখতেন দুই সমিতিই তবে লগ্নি বেশি ছিল যুববন্ধন সমিতির। এ ছাড়া তাঁরা পাওয়ার টিলারের ব্যবসাও শুরু করেন Ñ
২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের পর এলাকার রাজনৈতিক ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়। যুববন্ধন সমিতিটি মূলত যাঁর নেতৃত্বে চলত তাঁকে এলাকা ত্যাগ করতে হয়, তাছাড়া অন্যান্য সমস্যাও হয়, ফলে মুষ্টিচাল সমিতির কাজ অনেকটা তিগ্রস্ত হয়। “নির্বাচনের পর (জাতীয় সংসদ নির্বাচন অক্টোবর ২০০১) এখানকার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সবাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল,” জানান শাহানা। “তখন আমাদের সদস্য সংখ্যা ২৯ থেকে ১৬তে নেমে আসে। সদস্যরা সবাই সঞ্চয় বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে বেশিদিন নয়, মাস দুয়েক পর আবার সবাই জড়ো হয়ে আলাপ আলোচনা করে ঠিক করলাম, ‘না, সঞ্চয় বন্ধ করা চলবেনা।’ ” অক্টোবর, ২০০৩ সালে সমিতির সদস্য ছিল ১৬ জন।” (তবে এপ্রিল ২০০৫-এ এই প্রতিবেদনটির চূড়ান্ত যাচাইপর্বে সদস্য সংখ্যা ১৪তে নেমে এসেছিল)

মুষ্টিচাল সমিতি যেভাবে চলে

মুষ্টিচাল মহিলা সমিতি কাজ করতে করতে পথ ঠিক করে অগ্রসর হচ্ছে। শাহান কবির যেমনটা বলছেন, “আমরা তো কাউরে কিছু বলে কয়ে সমিতি বানাই নাই। নিজেরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিলাম এবার থেইকা মুঠ চাইলা সবাই একলগে জমা করব। এখানকার সবাই নিজেরা নিজেরা চাল জমা করত। সমিতি করার পর তফাৎ হলো যে তখন থেকে একসাথে জমা করতে শুরু করলাম।”

উদ্যোক্তারা বলেন এ সমিতি করার উদ্দেশ্য একটাই, নারীদের কিছু একটা করে আত্মনির্ভর হওয়া। মূল উদ্যোক্তার মনে হয়েছিল এই সমিতি করতে পারলে তাঁদের একটা শক্তি হবে, নিজস্ব একটা পুঁজি থাকবে যা কারো দয়ায় পাওয়া না বা যার উপর সংসারের অন্য কারো কোনো দাবী থাকবে না। “এরকম তো থাকাই উচিত,” বলেন শাহানা। “যে কোনো কিছুতে স্বামীর মুখের দিকে চাইয়া থাকা ছাড়া আমাদের তো আর গত্যন্তর নাই। স্ত্রীর নিজস্ব একটা পুঁজি থাকলে সেই সংসারে তার একটা আলাদা মর্যাদা থাকে। সেই কথা আমি সবাইকে বুঝাইছি।”

জুলাই ২০০০-এ শুরু করার পর প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠাতা ১০ জন সদস্য যাঁর যাঁর নিজের ঘরে চাল জমিয়ে মাস গেলে সবটা শাহানার কাছে জমা দিতেন। তিনি একটা বড় ডেকচিতে সেই চাল রাখতেন এবং সুযোগমতো সেখান থেকে চাল বিক্রি করতেন। কিন্তু অচিরেই দেখা গেল এটা পোষাচ্ছে না। চাল কিনতে যাঁরা আসতেন, তাঁরা অভাবী মানুষ। অনুনয়-বিনয় করে তাঁরা চালের দাম কমাতেন, শাহানাও তাঁদের চাপ দিতে পারতেন না। সুতরাং ন্যায্য দাম না পেয়ে সমিতি তি গুণতে থাকে। শেষে সকলে মিলে ঠিক করলেন যে, যে যার নিজের সঞ্চিত চাল বিক্রি করে প্রতি মাসে সমিতিতে ২৫ টাকা করে জমা দেবেন। এ নিয়মটিই এখনো চলছে। সমিতিতে ভর্তির সময় দিতে হয় এককালীন দুই টাকা।

মুষ্টিচাল সমিতির সভাপতি রেহানা বেগম, সহ-সভাপতি রহিমা বেগম। শাহানার মূল দায়িত্ব কোষাধ্যরে। তিনি বলেন, ‘কোষাধ্যরে কাজটা কঠিন। লেখাপড়া জানা দরকার। সমিতির মইধ্যে এই দায়িত্ব নেবার সাহস কেউ করতেছে না।’

সমিতির সদস্যরা সাধারণত শাহানা কবিরের বাসায় বৈঠক করেন। একসময় শাহানা নিয়মিত সমিতির সদস্যদের লেখাপড়া শেখাতেন। কয়েকজনকে তিনি বর্ণ চেনা, বর্ণ লেখা আর নাম সই করা শিখিয়েছেন। তবে ব্যস্ততার কারণে শাহানা এখন আর এ কাজটা পারছেন না। এ ছাড়া শাহানা সমিতির বৈঠকগুলোতে স্বাস্থ্য ও শিা সংক্রান্ত তথ্য বিতরণ করেন। তবে সদস্যরা সাংসারিক দায়িত্বের চাপেই মূলত লেখাপড়া শেখা কিংবা অন্যান্য দৈনন্দিন বিষয়ে আলোচনা সভা বা বৈঠক করার জন্য সময় দিতে পারেন না। সমিতিকে প্রয়োজনীয় সময়ও তাঁরা দিতে পারেন না। শাহানা নিজের চাকরি করেন, আবার ঘরও সামলান। বৈঠকগুলো সুতরাং অনিয়মিত।

সমিতির হিসাব-নিকাশ নিয়ে বসাটা একটা বড় উপল্য, যেমনটা বলছেন শাহানা, “সমিতির অর্থের হিসাব-নিকাশ আমিই রাখি। আমাদের অনিয়মিত বৈঠকে সবাইকে হিসাব-নিকাশ দেখাই। সবার সুবিধা অসুবিধা নিয়ে কথা বলি। এরকম তো গ্রামে-গঞ্জে মেয়েরা বসে। কেউ কেউ পাটি বানাইতে বানাইতে কথা বলে। কাজের অবসরে সবাই জড়ো হয়। আমরাও সেরকম বসি।”

২০০৫-এর এপ্রিল পর্যন্ত সমিতিটি সেভাবেই চলে আসছে। তবে এই সময়টাতে এসে মাসে একবারের বেশি সমিতির সদস্যরা বসতে পারেন না, এর একটি প্রধান কারণ শাহানা কবিরের সাংসারিক ব্যস্ততা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে।

সমিতির কোনো ব্যাংক একাউন্ট ২০০৫-এর এপ্রিল পর্যন্ত হয়নি। শুরু থেকেই শাহানা কবিরের নিজস্ব একাউন্টেই সমিতির টাকা-পয়সা রাখা হয়। শাহানার একাউন্ট আছে চৌমুহনীর ইসলামী ব্যাংকে। সমিতির নিজস্ব একাউন্ট করার ব্যাপারে বেশ কয়েকবার আলোচনা হলেও এখনো হিসাব-নিকাশে তেমন সমস্যা হচ্ছে না বলে সমিতির জন্য আলাদা একাউন্ট খোলা হয়নি। সমিতির একটি গঠনতন্ত্রও ইতিমধ্যে খসড়া করা হয়েছে। “গঠনতন্ত্র থাকলে সদস্যরা সেই নিয়ম ধরেই চলবে, সমিতিতে অনিয়ম হবে না, এসব চিন্তা করেই এটা বানিয়েছি,” জানান শাহানা।

মুষ্টিচাল সমিতির সঞ্চিত পুঁজির ব্যবস্থাপনা

মুষ্টিচাল সমিতি নিজেদের টাকা সাধারণত নিজেদের মধ্যে বা বাইরে ঋণ দেয় না। মাঝেমধ্যে নিতান্ত জরুরি প্রয়োজনে সমিতির সদস্যরা সর্ব্বোচ্চ ১,০০০.০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারেন। সুদমুক্ত এই ঋণের টাকা তাঁকে এক মাসের মধ্যে ফেরত দিতে হয়। সাধারণত গুরুতর পারিবারিক প্রয়োজনেই সদস্যরা এই ঋণ নিয়ে থাকেন। এখন পর্যন্ত কারোর েেত্র টাকা ফেরত দিতে এক মাসের বেশি সময় লাগেনি বলে সমিতির সদস্যরা জানান।
২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকেই মুষ্টিচাল সমিতি সদস্যদের জমানো টাকা যুববন্ধন বহুমুখী সমবায় সমিতির পুঁজির সাথে যোগ করে যৌথভাবে ব্যবসা শুরু করে। সমিতির সদস্যরা জানান, এই সময় নাগাদ সমিতির সঞ্চয় দাঁড়ায় ১৫ শ টাকা। পরে যাঁরা সমিতিতে ঢুকেছিলেন তাঁরা ২০০০ সালের জুলাই মাস ধরেই চাঁদা শোধ করাতে সমিতির এই পরিমাণ টাকা জমা হয়। এই টাকার সাথে যুক্ত হয় যুববন্ধন সমিতির নিজস্ব পুঁজি ৮,৫০০.০০ টাকা। এছাড়া দুটি সমিতি যৌথভাবে কমিউনিটি এডভান্সমেন্ট ফোরাম (সিএএফ-ক্যাফ) নামে স্থানীয় একটি এনজিও-র কাছ থেকে ১০,০০০ টাকা ধার নেয়। সর্বমোট এই ২০,০০০ হাজার টাকা নিয়ে তাঁরা শুরু করেন স্বাস্থ্যসম্মত কুয়া পায়খানার সরঞ্জাম তৈরি ও পাওয়ার টিলার ভাড়া দেয়ার ব্যবসা ’

“আমরা মিস্ত্রি দিয়ে পায়খানার রিং আর পিলার বানাতাম আর সেগুলো বিক্রি করতাম,” ব্যাখ্যা করেন শাহানা। “এতে দুইটা কাজ একসাথে হতো। স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার সংখ্যা বাড়ছিল আর আমাদের আয়ও হচ্ছিল। তাছাড়া পাওয়ার টিলার এখানে কাজে কৃষি কাজে লাগে। সেই পাওয়ার টিলার ভাড়া দিয়েছি।” আবু তাহের নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে জায়গা লিজ নিয়ে সেখানে এই রিং ও পিলার বানানোর কাজ চলত। ২০০১-এর অক্টোবর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেলে কিছু স্থানীয় চাঁদাবাজ রিং বানানোর কাজে বাধা দেয়, বলে তাদেরকে চাঁদা না দিলে রিং বানাতে দেয়া হবে না। তাছাড়া যুববন্ধন সমিতির পরিচালক ও মুষ্টিচাল সমিতির কিছু সদস্যের পরিবার রাজনৈতিক চাপে পড়ে যায়, এর ফলে ব্যবসায়ে খাটানো টাকা মার যাওয়ার ভয়ে মুষ্টিচাল সমিতির কিছু সদস্য তাঁদের লগ্নি তুলে নিয়ে সমিতি ছেড়ে যান। এভাবে রিং ও পিলার বানানোর কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। এসব অস্থিরতার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় পাওয়ার টিলারের ব্যবসাও।

মুষ্টিচাল সমিতির সদস্যরা জানান, যুব-বন্ধন সমিতির সাথে তাঁদের শর্ত ছিল, বিনিয়োগ অনুযায়ী লাভ ভাগ হবে। যখন ব্যবসা ছিল তখন সমিতির সবাই মিলে তদারকির কাজটা করতেন। নিয়মিত বৈঠকে বসে দুই সমিতির সদস্যরা কাজের পর্যলোচনা করতেন। অর্ডার পেলে রিং বানানো হতো। ক্রেতা এসে নিয়ে যেতেন। হিসাব-নিকাশে সমস্যা হতো না কারণ রিং কত দিয়ে বিক্রি হয়, কয়টা বানানো হয় এ সব সবাই জানতেন, পারস্পরিক বিশ্বাসও ছিল। তবে ব্যবসাটি আচমকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মাঠে অনেক টাকা অনাদায়ী রয়ে যায়।

ব্যবসা বন্ধ হওয়ার মাস দুয়েক পর থেকে মুষ্টিচাল সমিতির অবশিষ্ট সদস্যরা আবার একত্র হয়ে সঞ্চয় করতে শুরু করেন। তাঁরা মাঠে বাকি পড়া টাকা উঠিয়ে আনতে উদ্যোগ নেন, বিনিয়োগ আর লাভের হিসাব-নিকাশ করতে বসেন। শাহানার হিসাবে এক বছরে এই ব্যবসায়ে দুই সমিতি যা বিনিয়োগ করেছিল তাতে আট থেকে দশ হাজার টাকা লাভ হওয়ার কথা ছিল। শেষতক তাঁরা বিনিয়োগকৃত ২০,০০০ টাকা পুঁজির পুরোটা তুলতে পারলেও লাভ তুলে আনতে পেরেছিলেন হাজার সাতেক টাকা।

২০০৩-এর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তাঁরা সমিতি গোছানো, টাকা জমানো ও বকেয়া টাকা তোলার কাজ করেন। তারপর ২০০৩-এর মাঝামাঝি সময়ে মুষ্টিচাল সমিতি ও যুববন্ধন সমিতি তাদের পুঁজি আবার একত্র করে যৌথভাবে স্থানীয় ওয়েভ মিনারেল-ওয়াটার কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। শাহানা জানান মুষ্টিচাল সমিতি দেয় ৯,৫০০ টাকার মতো এবং যুব-বন্ধন সমিতি দেয় ১৩,০০০.০০ টাকার কিছু বেশি পুঁজি । শর্ত ছিল কোম্পানি ২০০৪-এর মে মাসে ৫০০০.০০ টাকা লাভ দেবে।

২০০৫-এর এপ্রিলে এই গবেষণা-প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার সময় জানা যায় যথাসময়ে এই লাভসহ সম্পূর্ণ পুঁজি তুলে এনে মুষ্টিচাল সমিতি ও যুব-বন্ধন সমিতি এখন যৌথভাবে মোট প্রায় ৩০,০০০.০০ সুদে খাটিয়েছেন। একটি জায়গাতেই তাঁরা পুরো টাকাটা ধার দিয়েছেন। এর প্রায় ১০ হাজার টাকা মুষ্টিচাল সমিতির আর ১৩ হাজার টাকা যুববন্ধন সমিতির আদি পুঁজি বাকি ৭০০০ টাকা স্যানিটেশন ব্যবসা থেকে আসা লাভ। ব্যবসার শর্ত, ঋণগ্রহীতা ২০০৫-এর মে মাসে অর্থাৎ এক বছর শেষে হাজারে ৩০০ টাকা করে সুদ দেবেন। মুষ্টিচাল সমিতির সদস্যরা আশা করছেন ২০০৫-এর মে মাসে তাঁরা লভ্যাংশ পাবেন। যাঁকে টাকাটা দেয়া হয়েছে তাঁর ওপর দুই সমিতির সকলের আস্থা আছে। এ ছাড়া শাহানা কবির জানান, এলাকার পরিবেশ অনেক দিন হয় আবার শান্ত হয়েছে, তাঁরাও সমিতির কাজ করতে পারছেন।

২০০৫-এর জুন মাসে মুষ্টিচাল সমিতির পাঁচ বছর পূর্তি হবে। এ উপলে মুষ্টিচাল সমিতি ও যুব-বন্ধন সমিতি একত্রে বসে গত পাঁচ বছরের ব্যবসার লাভ বন্টন করে নেবে। এখনো পর্যন্ত মুষ্টিচাল সমিতির টাকা শাহানা কবিরের মাধ্যমেই ব্যবহার হয়েছে।

এদিকে গোড়ায় নিজেদের স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার সরঞ্জাম তৈরির ব্যবসা চালানোর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে মুষ্টিচাল সমিতির সদস্যরা বলেন, রিং-পিলার এগুলো বানানোর জন্য যুববন্ধন সমিতির ছেলেরা নিজেরা ইট ভাঙতেন, নিজেরাই হাতে হাতে সব যোগাড়-যন্ত্র করতেন দেখে পাড়া-প্রতিবেশিরা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতেন যার ফলে এসব তরুণ অপমান বোধ করতেন, বিব্রত হতেন। তাছাড়া দাম আদায়ের জন্য ক্রেতাদের পেছনে পেছনে প্রচুর ঘুরতে হতো। এসব অভিজ্ঞতার কারণেই তাঁরা শেষ পর্যন্ত নিজেরা ব্যবসা করা ছেড়ে কারো তৈরি ব্যবসাতে পুঁজি খাটাতে আগ্রহী হয়েছেন। সুদের ব্যবসাতে নেমেছেন মূলত দ্রুত পুঁজি বাড়ানোর ল্েয।

সমিতির সদস্যরা
২০০৩-এর অক্টোবর নাগাদ স্টাডি চলাকালীন মুষ্টিচাল মহিলা সমিতির ১৬ জন সদস্যের মধ্যে একটি প্রাথমিক জরিপ করা হয়। এঁদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত এবং সবাই গৃহিনী।

১. শাহানা কবির (৪৩), প্রতিষ্ঠাতা মূল উদ্যোক্তা এবং কোষাধ্য। । তিনি পেশায় স্কুল শিকিা, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। তিনিই পরিবার পরিচালনা করেন। জমি আছে এক একর আট শতাংশ, ফসল পান। দুই সন্তান রয়েছে Ñ তারপর????

২. রেহানা বগম (৪১), প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং সভাপতি । তিনি এইচএসসি পাশ। (এপ্রিল ২০০৫-এ স্বামী নূরুল আলম একটি প্রাইভেট কোম্পানির হিসাব বিভাগে চাকরি করছিলেন। রেহানার নিজের আছে এক একর আট শতাংশ জমি এবং স্বামীর আছে ৩০ শতাংশ জমি।)

৩.
৪. রহিমা বেগম (৩০), প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং সহ-সভাপতি। তিনি পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। স্বামী জাফর আহমেদ পেশায় ুদ্র ব্যবসায়ী এ ছাড়া একটি ছোট সোনার অলঙ্কারের দোকান ভাড়া দেয়া আছে। জমি আছে নয় শতাংশ। পারিবারিক আয় মাসে ২৫০০-৩০০০ টাকা। রহিমা বেগম ব্র্যাক-এর ুদ্র-ঋণ সমিতির সদস্য, ঋণের টাকা সোনা বন্ধকীর ব্যবসায়ে খাটান স্বামীর ব্যবসাতেই খাটান। (এপ্রিল ২০০৫-এ তাঁদের ১৩ বছর বয়সী চার সন্তানের বড় মেয়েটি সপ্তম শ্রেণীতে এবং এক ছেলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে। পরের দুটি ছেলেমেয়ে ছোট, এখনো স্কুলে যায় না।)

৫. আয়েশা খাতুন (৪৮), প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি নাম স্বার করতে পারেন। স্বামী নূর ইসলাম চৌমুহনীতে জুটমিলের শ্রমিক ছিলেন (এপ্রিল ২০০৫-এ তিনি ছিলেন বেকার।) জমি আছে ৭২ শতাংশ, ৭০ শতাংশে কৃষি আবাদ করেন। এক ছেলে এক মেয়ে তাঁদের। (স্বামীর চাপে এবং সমিতির সঞ্চয় দিতে না পেরে আয়শা খাতুন ২০০৪ সালে সমিতি ছেড়ে দিয়েছেন। এপ্রিল ২০০৫-এ কুড়ি-একুশ বছর বয়সী বড় ছেলেটি ছিলেন পরিবারের মূল উপার্জনকারী, কাস সেভেন/এইট পর্যন্ত পড়ে তিনি দোকানে কাজ করছিলেন; ১৬/১৭ বছর বয়সী মেয়েটি ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে বাসায় বসা।)

৬. মরিয়ম বেগম (৪০), প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি নাম স্বার করতে পারেন। স্বামী আব্দুল মতিন, পেশায় দিনমজুর। জমি আছে নয় শতাংশ। স্বামীর আয়েই মূলত সংসার চলে। (স্বামীর চাপে মরিয়ম বেগম ২০০৪ সালে সমিতি ছেড়ে দিয়েছেন। এপ্রিল ২০০৫-এ তাঁদের একমাত্র ছেলের বয়স ১৯/২০ বছর, বেকার; তিন মেয়ের বড়টি কাস ফোরে পড়ে, অন্য দুজন ছোট।)

৭. আমেনা বেগম (৪২), প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি লিখতে ও পড়তে পারেন। (এপ্রিল ২০০৫-এ স্বামী খুরশীদ আলম চৌমুহনীতে জুটমিলে ফোরম্যানের চাকরি করছিলেন। জমি আছে আট শতাংশ। মাসিক পারিবারিক আয় ৫০০০ টাকা। তাঁদের দুই ছেলের বড় জন দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে দোকানে কাজ করছে; বারো বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে পড়ছে কাস ফাইভে; ছোট ছেলে কাস ওয়ানে।)

৮. তাহেরা বেগম (৩২), প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি অল্প অল্প বাংলা পড়তে জানেন। স্বামী মৃত আমীর আহমেদ। জমি আছে নয় শতাংশ। তাহেরা বেগম ব্র্যাক-এর ুদ্র-ঋণ সমিতির সদস্য, ঋণের টাকা সোনা বন্ধকীর ব্যবসায়ে খাটান। আয় খুব সামান্য। দুই ছেলে দুই মেয়ে তাঁর। (এপ্রিল ২০০৫-এ প্রাইমারি-পাশ ১৫/১৬ বছর বয়সী বড় ছেলেটি বেকার; তের-চোদ্দ বছর বয়সী বড় মেয়ে কাস সেভেনের, দশ বছর বয়সী দ্বিতীয় মেয়েটি পড়ে চতুর্থ শ্রেণীর এবং সাত বছর বয়সী ছোট ছেলেটি প্রথম শ্রেণীর ছাত্র।) বিধবা তাহেরাকে তাঁর ভাইয়েরা দেখাশুনা করেন।

৯. ফয়জুন্নেসা (৬০), সদস্য হয়েছেন ২০০০ সালের শেষের দিকে। সমিতির সবচেয়ে বয়োজ্যোষ্ঠ এই সদস্য নিরর। স্বামী রমজান আলী ুদ্র ব্যবসায়ী, বাজারে শাক-সবজি বিক্রি করেন। জমি আছে ২৫ শতাংশ। তাঁদের তিন মেয়ে তিন ছেলে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে, শ্বশুরবাড়ি থাকে। এক ছেলের বিয়ে হয়েছে, বাবার সাথেই থাকেন। বড় দুই ছেলে বাবার সাথে সবজির কারবার করেন, বড় ছেলে দিনমজুরিও করেন। (এপ্রিল ২০০৫-এ ১৬/১৭ বছর বয়সী ছোট মেয়েটি নবম শ্রেণীতে এবং ছোট ছেলেটি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছিল, একলাশপুর হাই স্কুলে।)

১০. শিরি (৩২), সদস্য হয়েছেন ২০০০ সালের শেষের দিকে। তিনি নবম শ্রেণী পাশ। স্বামী আবদুল করিম একজন কাঠমিস্ত্রি। জমি আছে ৩০ শতাংশ। পারিবারিক আয় মাসে গড়ে ৩০০০ টাকা। (এপ্রিল ২০০৫-এ তাঁদের দুই সন্তানের বড় মেয়ে কাস ফাইভে পড়ছিল।)

১১. মামুনা বেগম (৩৫), সদস্য হয়েছেন ২০০০ সালের শেষের দিকে। তিনি পঞ্চম শ্রেণী পাশ। স্বামী আবদুর রহিম একজন নির্মাণ-শ্রমিক। জমি আছে ৩০ শতাংশ। পারিবারিক আয় মাসে গড়ে ৩০০০ টাকা। (এপ্রিল ২০০৫-এ তাঁদের দুই সন্তানের বড় মেয়েটি চতুর্থ শ্রেণীর এবং ছয় বছর বয়সী ছেলে শিশু শ্রেণীতে পড়ছিল ।)

১২. নুরুন্নেছা (৩৫), সদস্য হয়েছেন ২০০০ সালের শেষের দিকে। তিনি পঞ্চম শ্রেণী পাশ। স্বামী ইসমাইল হোসেন ঢাকায় একটি কাঁচ-কারখানায় চাকরি করছিলেন। জমি আছে ৩০ শতাংশ, এপ্রিল ২০০৫-এ তাঁদের তিন সন্তানের বড় মেয়েটি ও ছেলেটি মাদ্রাসায় পড়ছিল; ছোট মেয়েটি শিশু বয়সী।)

১৩. নুরুন্নাহার (২৫), সদস্য হয়েছেন ২০০০ সালের শেষের দিকে। তিনি পঞ্চম শ্রেণী পাশ। স্বামী দিনমজুরি করে সংসার চালান। জমি আছে আট শতাংশ। মাসিক পারিবারিক আয় গড়ে ২০০০ টাকা। (এপ্রিল ২০০৫-এ তাঁদের দুটি সন্তানই খুব ছোট, স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি।)

১৪. কুলছুম (২০), সদস্য হয়েছেন ২০০৩ সালে। তিনি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। স্বামী আবুল কালাম, পেশায় গাড়িচালক। প্রাইভেট কোম্পানির মাইক্রো চালাতেন। (এপ্রিল ২০০৫-এ তিনি সৌদি আরবে কর্মরত। ধারদেনা করে, জমি বন্ধক রেখে বিদেশে গেছেন, তখনো টাকা শোধ করতে পারেননি। জমি আছে ১৬ শতাংশ। স্বামীর অনুপস্থিতিতে শ্বশুর পরিবারকর্তা। একমাত্র ছেলেটির বয়স চার বছর।)

১৫. বেগম নূর-ই-জিন্নাত শাকিলা (২৮), সদস্য হয়েছেন ২০০৩ সালে। তিনি বিএ পাশ। স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান বেগমগঞ্জ থানারই আরেকটি ইউনিয়নে অবস্থিত কাজীরহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক। জমি আছে ১৬ শতাংশ। পরিবারটি স্বচ্ছল, ঘরে রেডিও, টিভি, ড্রেসিং টেবিল, ইত্যাদি রয়েছে। (এপ্রিল ২০০৫ পর্যন্ত তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না।)

১৬. বিবি রহিমা (৪০), তিনি নাম স্বার করতে জানেন। স্বামী আবদুর রশিদ একজন দিনমজুর। তাঁদের আছে দুই-আড়াই শতাংশ ভিটা-জমি মাত্র।

১৭. সাকেরা বেগম (৩৫) তিনি নাম স্বার করতে পারেন। স্বামী সালাউদ্দিন রিক্সাচালক, রিক্সাটি তাঁর নিজের। জমি আছে পাঁচ শতাংশ। মাসিক আয় গড়ে ২০০০ টাকা। এপ্রিল ২০০৫-এ তাঁদের তিন সন্তানের বড় তেরো বছর বয়সী মেয়েটি একলাশপুর হাইস্কুলে, এবং দশ বছর বয়সী ছেলে ও সাত বছর বয়সী মেয়েটি একলাশপুর প্রাইমারি স্কুলে পড়ছিল।

২০০৩-এর অক্টোবর মাসে স্টাডি চলাকালে মুষ্টিচাল মহিলা সমিতির ১৬ জন সদস্যের মধ্যে তিনজনের বাড়িতে কোনো স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ছিল না। অধিকাংশ সদস্যই গৃহিণী। প্রতিটি পরিবার হাঁস-মুরগি পালন করে, এ থেকে সামান্য আয় হয়। গ্রামের এই মহিলাদের জীবন একেবারে নিজস্ব গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ একেবারে নেই বললেই চলে। সমিতির সদস্যদের মধ্যে অনেকেই বেত ও বাঁশের কাজ করেন যা নিতান্ত সাংসারিক কাজে ব্যবহার হয়। কেউ কেউ সেলাই জানেন। সমিতির সদস্য হওয়ার পর পড়ালেখার প্রতি এঁরা প্রায় সকলেই খুব আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। সবাই চান সমিতির মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হতে।

সদস্যদের পরিবারে প্রতিক্রিয়া
সমিতিটি করার সময় মূল উদ্যোক্তা শাহানা কবির নিজেই পরিবারের মাথা হওয়াতে কোনো সামাজিক বা পারিবারিক বাধার সম্মুখীন হননি, তবে তিনি যখন সমিতিটি করতে উদ্যোগী হন তখন আশেপাশে তাঁর পাড়া-প্রতিবেশি ও আত্মীয়-স্বজনরা মন্তব্য করেছিলেন, এসব করে লাভ নেই, দুদিন পরেই সমিতি ভেঙে যাবে। যাঁরা তাঁর সাথে সমিতিতে যোগ দিয়েছেন তাঁদের কেউ কেউ কিছুটা হলেও পারিবারিক বাধার মুখে পড়েছিলেন। আবার কেউ কেউ স্বামী বাধা দেবেন মনে করে তাঁকে আগে বলেননি, কিন্তু স্বামী যখন জানতে পেরেছেন তখন উৎসাহই দেখিয়েছেন। নিচে সমিতির কয়েকজনের অভিজ্ঞতার কথা সংেেপ দেয়া হলো।



ঘটনাচিত্র -১
এপ্রিল ২০০৫-এ এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার সময় প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন মরিয়ম বেগম আর সমিতিতে ছিলেন না। তাঁর চার সন্তান। দিনমজুর স্বামী আবাদুল মতিনই সংসারের মূল উপার্জনকারী। ঘরসহ ভিটাজমি আছে নয় শতাংশ, কোনো কৃষিজমি নেই। স্বামী দিনমজুরি করেন বলে বর্ষা-বাদলে বা তাঁর অসুখ-বিসুখ হলে পরিবারের আয়ও বন্ধ হয়ে যায়। তখন ধারদেনা করেই সংসার চালাতে হয়। ঘরে সম্পদের মধ্যে দুচারটি হাঁড়ি-পাতিল, একটি শোয়ার চৌকি ও কাঁথা-বালিশ। ঘরের মধ্যেই মরিয়ম বেগম কয়টি হাঁস ও মুরগি পালন করেন, তা থেকে বছরে চার/পাঁচ শ টাকা আয় হয়। তাঁদের বাড়িতে কোনো স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নেই। পরিবারে প্রায়ই রোগ-বালাই লেগে থাকে। এর জন্য তাঁরা পানিপড়া ও তাবিজের উপর নির্ভর করেন। মরিয়ম বেগম সরকারের টোটাল লিটারেসি মুভমেন্ট (টিএলএম)-এর অধীনে পরিচালিত শিাকেন্দ্র থেকে নাম স্বার করা শিখেছেন। পাশের বাড়িতে গিয়ে মাঝে মাঝে তাঁরা টিভি দেখেন। খবর নিয়মিত শোনা হয় না, তবে উল্লেখযোগ্য খবর শুনে থাকেন। টিভিতে নাটক হলে খুব আগ্রহভরে তা দেখেন। তিনি কোনো পত্রিকার নামও জানেন না।

সমিতিতে যোগ দিয়ে মরিয়ম বেগম চেয়েছিলেন এর মাধ্যমে কিছু আয় করে সে টাকা দিয়ে নিজে কিছু করতে। তিনি কোনো কোনো সময় পরিবারে নিজের সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। মরিয়ম জানান পরিবারে ঝগড়াঝাঁটি হলেও তা কখনো মাত্রা ছাড়ায়নি তবে তিনি প্রায়ই স্বামীর ছোটখাট মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। এর জন্য স্বামীর সঙ্গে মাঝে মাঝে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে তিনি চান পরনির্ভরশীল না হয়ে নিজে কিছু করে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে যদিও এই এলাকার অতি গরিব পরিবারে আলাদাভাবে নিজস্ব কাজের জন্য কিছু করা মেয়েদের পে খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার।

মরিয়ম বেগমের স্বামী স্ত্রীর সমিমিতে যোগ দেয়ার কথা কিছুই জানতেন না। সমিতিটি সম্পর্কে জানাজানি হলে মরিয়মের স্বামীও এ সম্পর্কে জানতে পারেন এবং বলেন যে মুঠ চাইলা ঘরের লক্ষ্মী, দেয়া উচিত না। তাছাড়া মাসে ২৫ টাকা করে সমিতির চাঁদা শোধ করার ব্যাপারে স্বামীর বিশেষ আপত্তি ছিল। কিন্তু সমিতি করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন মরিয়ম, এর একটি কারণ সমিতিতে যোগ দেয়ার বছরখানেকের মাথায় তিনি সমিতি থেকে ঘর তোলার জন্য ৩০০ টাকা ধার পান। প্রয়োজনের মুহূর্তে সুদমুক্ত এই টাকা পাওয়ার ব্যাপারটি তাঁকে আরো বেশি করে সমিতিমুখী করেছিল, কিন্তু মূলত স্বামীর চাপেই মরিয়ম বেগম ২০০৪-এর মাঝামাঝি সমিতি ছাড়তে বাধ্য হন।

ঘটনাচিত্র - ২
প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন এবং সমিতির সভাপতি রেহানা বেগম (৪১) সমিতির কাজে আসেন স্বামী নুরুল আলম (৫৫)-এর অজান্তে। তিনি বলেন, “যখন সমিতির ব্যাপারে সাংবাদিকদের প থেকে খোঁজ-খবর শুরু হয়, তখন আমার স্বামী ব্যাপারটি জানতে পারেন।” কিন্তু জানার পর নুরুল আমিন রাগ করেননি। যদিও আগে তিনি মনে করতেন সমিতির পেছনে সময় আর শ্রম দিয়ে কোনো লাভ হয় না, মুষ্টিচাল সমিতিটিকে চোখের সামনে দাঁড়াতে দেখে তাঁর ধারণা বদলিয়েছে। তিনি সমিতিটির ওপরে অনেকটা আস্থা পেয়েছেন। সমিতির সদস্যরা যখন হাতের কাজ শিখে সেগুলো বানিয়ে বিক্রি করার পরিকল্পনা করছিলেন এবং এজন্য জায়গা খুঁজছিলেন তখন নুরুল আমিন সেই জায়গা দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। যাই হোক, সেই পরিকল্পনা এখনো বাস্তবে রূপান্তরিত হয়নি।

ঘটনাচিত্র - ৩
সমিতির একমাত্র বিএ পাশ সদস্য বেগম নূর-ই-জিন্নাত শাকিলা। তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক। তাঁদের সন্তানাদি নেই। নূর-ই-জিন্নাত একজন গৃহিণী। তবে সংসার নির্ঝঞ্ঝাট হওয়ায় বাড়িতে গরু-হাঁস-মুরগি এসব পালন করতে পারেন না। তাঁদের বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা রয়েছে। অসুখ-বিসুখে তাঁরা সাধারণত ডাক্তারের কাছেই যান। নিজেদের সাদা-কালো টেলিভিশনে তাঁরা অনুষ্ঠান দেখেন, খবর দেখেন নিয়মিত। টিভিতে বেশি দেখেন নাটক ও গান। প্রতিদিন পত্রিকা না পড়লেও প্রায়ই পড়েন। নূর-ই-জিন্নাত পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো স্বামীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নিয়ে থাকেন, অর্থাৎ পারিবারিক সিদ্ধান্তগুলোতে তাঁর অংশগ্রহণ ও মতামত থাকে। স্বামীর সঙ্গে তাঁর বেশ সু-সম্পর্ক রয়েছে। তিনি স্বামীর কোনো নির্যাতনের শিকার কখনো হননি। সমিতি করার ব্যাপারে স্বামী তাঁকে উৎসাহই যুগিয়েছেন।

নূর-ই-জিন্নাত মনে করেন পরনির্ভরশীল হয়ে থাকা নারীদের জন্য খুরই অপমানকর, খারাপ। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্যই মূলত তিনি একটি স্কুলে শিকের চাকরি নেন কিন্তু চাকরিটি পছন্দ না হওয়াতে ছেড়েও দেন। এখন তিনি উপার্জনের জন্য কোনো কাজ করছেন না। সর্বেেত্র তিনি স্বামীর সহযোগিতা পেয়ে আসছেন।

ঘটনাচিত্র - ৪
এপ্রিল ২০০৫-এ এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার সময় প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন আয়েশা খাতুন আর সমিতিতে ছিলেন না। সংসারে আর্থিক সঙ্কট প্রকট। পাটকল শ্রমিক স্বামী খুরশীদ আলম এখন বেকার, ছেলে দোকানে কাজ করে সংসার চালায়। আয়েশা খাতুন সারাদিন সংসারের কাজ করে অন্য কিছু করার সময় পান না। কয়টা হাঁস-মুরগি পালন করেন। এ থেকে বছরে প্রায় হাজার খানেক টাকা আয় হয়। তাঁদের বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নেই। তিনি টিএলএম কর্মসূচির আওতায় নাম স্বার করতে শিখেছেন। তাঁর রেডিও-টেলিভিশন শুনা বা দেখা হয় না। পত্রিকার নামও জানেন না।

পরিবারের কোনো কাজে আয়েশা খাতুনের মতামত একেবারেই নেয়া হয় না, স্বামীই সব সিদ্ধান্ত নেন। স্বামীর কড়া শাসনে নিজে কিছু করতে পারেন না, সব সময় স্বামীর অনুগত হয় থাকতে হয়। মাঝে মাঝে স্বামী শারীরিক নির্যাতন করেন আর সার্বণিক মানসিক নির্যাতন তো রয়েইছে। কোনো কাজেই স্বামী কিংবা পরিবারের সহযোগিতা পান না। তিনি সমিতির মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হতে চেয়েছিলেন কিন্তু স্বামীর চাপে ও সমিতির টাকা শোধ করতে না পেরে ২০০৪-এর মাঝামাঝি সমিতি ত্যাগ করেন।


মুষ্টিচাল সমিতি ভবিষ্যতে যা করতে চায়

মুষ্টিচাল সমিতির সদস্যরা তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বা আশা সম্পর্কে যা জানিয়েছেন:
ক্স যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁরা সমিতির নিবন্ধিকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চান।
ক্স আর দুই বছর পর তাঁরা সমন্বিত পুঁজি দ্বারা একটি বিক্রয় কেন্দ্র খুলতে চান, যেখানে মুষ্টিচাল মহিলা সমিতির সদস্যাদের হাতের কাজ করা সামগ্রী, পোষাক ইত্যাদি বিক্রি হবে। এ জন্য তাঁরা প্রয়োজনীয় প্রশিণ পেতে চান। তাঁরা চান সেলাই, বাটিক আর ব্লক, বাঁশ-বেতের কাজ এসব শিখতে। সমিতির সদস্যরা জানান বহু আগে সরকারের যে দপ্তর এখানকার মেয়েদেরকে এসব প্রশিণ দিয়েছিল তার অফিস ছিল দালানবাড়ি থেকে দুই-তিন কিলোমিটার দূরে। এখন সেখানে তাদের অফিসটি আর নেই। তাই হাতের কাজ শেখানোর একজন ভালো প্রশিক অনেক খুঁজেও তাঁরা এখনো যোগাড় করে উঠতে পারেননি। পেলে তাঁরা অচিরেই হাতের কাজ শেখার কাজটা শুরু করতে পারবেন।

একলাশপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান এই গবেষকের সাথে আলাপ হওয়ার আগে এই সমিতিটি সম্পর্কে তেমন অবগত ছিলেন না (২০০৩ সালের শেষ নাগাদ)। তিনি সমিতিটির ব্যাপারে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করে বললেন সমিতিটির সাথে আলাপ করবেন। তবে মুষ্টিচাল সমিতির মতোই এলাকার মহিলাদেরকে সংগঠিত করবেন কি না এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “মহিলারা নিজে থেকে উদ্যোগী না হলে করা যাবে না, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।” মুষ্টিচাল সমিতির সদস্যরা যে সব প্রশিণ চেয়েছেন সে ব্যাপারে সহযোগিতা করতে তিনি সম্মতি জানালেও কীভাবে করবেন সে নিয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি।

গবেষণা তত্ত্বাবধানকারীর কথা
২০০৫-এর এপ্রিলে এই প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করার সময় মুষ্টিচাল সমিতির সদস্য সংখ্যা ১৪-তে নেমে গেছে। স্বামীর চাপেই মূলত কয়েক মাস আগে সমিতি ছেড়ে গেছেন একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মরিয়ম বেগম। আরেকজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আয়শা খাতুনও চলে গেছেন, মূলত স্বামীর চাপে এবং অংশত কিস্তির টাকা শোধ চালাতে না পেরে। এঁরা চলে গেছেন ২০০৪-এর মাঝামাঝি সময়ে।

দালানবাড়ির গৃহবধূদের উদ্যোগে পরিচালিত মুষ্টিচাল সমিতিটি খুবই ধীরে ও নিজস্ব গতিতে পরিচালিত হচ্ছে। সদস্যদের কয়েকজন মধ্যবিত্ত গৃহিনী হলেও অধিকাংশই অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। একেক জন একেক ধরনের পারিবারিক প্রোপট থেকে এসে থাকলেও সবাই আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য উদগ্রীব। সবাই চান নিজেকে অন্যের কাছে ছোট না করে আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে। সামাজিক পশ্চাদপদতার জন্য এঁদের অনেকেই লেখাপড়া করেননি, অথচ এঁদের মধ্যে আছে লেখাপড়ার বিপুল আগ্রহ। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ পরিবার ও স্বামীর কাছ থেকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন, এ অবস্থায় অনেকেই মুষ্টিচাল মহিলা সমিতিতে মুক্তির পথ খুঁজতে চেয়েছেন।

দলবদ্ধ হয়ে সমিতির সদস্যরা একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েছেন, সবাই চান কিছু একটা করতে। তাঁরা বুঝতে পারছেন পড়ালেখা না জানাটা একটা বড় বাধা। সকলের মধ্যেই জানার আগ্রহ প্রবল। সমিতির সকলে চান বিভিন্ন প্রশিণ নিতে। প্রতিদিন এক মুঠো চাল দিয়ে সঞ্চয় করা খুবই ধীর লয়ের, তবে এর মধ্যে রয়েছে একটা ঐক্যের শক্তি। সমিতিটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য, যে সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে সমিতি ছেড়ে গেছেন তাঁরা এখনো সমিতির বৈঠকগুলোতে আসেন, নিজের ও পরিবারের নানা প্রয়োজনে সমিতির সাথে পরামর্শ করেন, সমিতির সদস্যদের পরামর্শও দেন। অর্থাৎ কাছাকাছি এলাকাতে বাস করায় এবং একসময় সমিতির সাথে থাকায় পরস্পরের ভেতরে যে সখ্য গড়ে উঠেছিল, সমিতির সদস্যপদ ছেড়ে দিলেও তা অনেকটাই অটুট আছে।

সমিতির উদ্যোক্তা এখনো পর্যন্ত সমিতিটির প্রধানতম খুঁটি, একমাত্র খুঁটিও বলা যায়। তাঁর বাইরে এই সমিতি চালানোর নেতৃত্বসুলভ মতা এর অন্যান্য সদস্যের মধ্যে সেভাবে গড়ে ওঠেনি বলেই এই গবেষণা তত্ত্বাবধানকারীর মনে হয়েছে। তবে শাহানা জানিয়েছেন তিনি মনে করেন বেগম নূর-ই-জিন্নাত শাকিলার মধ্যে সমিতি চালানোর কিছু গুণ তিনি দেখতে পেয়েছেন। অপোকৃত কমবয়সী এই সদস্য “বোঝে ভালো, লেখাপড়া বেশি, পরিবারে ঝামেলা কম।” তাঁর আশা আরেকটু বয়স বাড়লে, অভিজ্ঞতা হলে এবং স্থিতি এলে শাকিলা সমিতির অনেক দায়িত্ব নিতে পারবেন।

সমিতির বেশির ভাগ সদস্য কোনো এনজিও থেকে ঋণ নেন না বা সদস্যও না, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যাপারে শাহানার দৃঢ় অবস্থানকেই এর কারণ বলে মনে হয়েছে, সমিতির বাকি সদস্যরা যার দ্বারা প্রভাবিত। যদিও মুষ্টিচাল সমিতিটি অতীতে দলবদ্ধভাবে অন্য এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছে।

দালানবাড়ির মুষ্টিচাল সমিতি দেশের অন্যান্য এলাকার নারীদেরকেও উদ্বুদ্ধ করছে, সুদূর মাগুরায় এ ধরনের সমিতি গঠন করেছেন মেয়েরা, সুধারামের সুজাপুর এবং হাতিয়াতেও গড়ে উঠেছে মুষ্টিচাল মহিলা সমিতি। পরিশেষে শাহানা কবীরের সূত্র ধরেই বলা চলেবাংলার অবহেলিত নারীরা দালানবাড়ি মুষ্টিচাল মহিলা সমিতির উদাহরণ ধরে দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যাক উন্নতির ল্েয, দালানবাড়ির অরুণ আলোকে সূর্যোদয় হোক।

নোয়াখালীর দুঃখ ‘নোয়াখালী খাল’


নোয়াখালীর দুঃখ ‘নোয়াখালী খাল’
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

নোয়াখালী খাল হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের জনবসতির উপর এক ব্যাপক প্রভাব ফেলে আসছে। এ খালটিই ছিল একদিন নোয়াখালীর জনগণের জন্য স্বর্গীয় আর্শীবাদ। কিন্তু এ খালটি এখন উপকূলীয় এ জনগণের দুর্ভোগের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পলিমাটি সমৃদ্ধ নতুন ভূমি সাগর থেকে জেগেওঠার ফলে সাগর যত দক্ষিণে সরে গেছে ততই উজানে এ খালের তলদেশে পলি জমে জমে ভরাট হয়ে গেছে। দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এ খাল সংস্কার করার কথা থাকলেও এ অঞ্চলের অন্যতম সমস্যা জলাবদ্ধতার নির্মম শিকারে নিপতিত হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে বিপুল জনগোষ্ঠী। চীনের হোয়াংহো নদীকে যেমন চীনের দুঃখ বলা হয় তেমনি নোয়াখালী খালকে ‘নোয়াখালীর দুঃখ’ বলে অভিহিত করা হয়। নোয়াখালী খালটি ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে পানি নিষ্কাশনের কার্যকারিতা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। নোয়াখালী খালসহ জেলার বিভিন্ন সংযোগ খালগুলোও এভাবে বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে ব্যাপক জলাবদ্ধতার কারণে নোয়াখালী জেলাবাসীর জীবনে নেমে আসে চরম দূর্ভোগ। খালের মুখে পলি মাটি জমে বিপুল পরিমাণ আবাদী জমির চাষাবাদ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। এজন্য প্রায় দশ কোটি টাকার ফসল উৎপাদন থেকে জেলাবাসী বঞ্চিত। বর্তমানে নোয়াখালী জেলার আয়তন তিন হাজার ছয়শ দশমিক নিরানব্বই বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে সুধারামের আয়তন এক হাজার একাত্তর দশমিক ছিষট্টি বর্গ কিলোমিটার যা পার্শ্ববর্তী ফেণী জেলা থেকেও বেশী।
সমস্যার নিরসনকল্পে সত্তর দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন র্বোড একটি প্রকল্প হাতে নেয়। সে প্রকল্পে রহমত খাল এবং নোয়াখালী খালের ভাটিতে দুটি রেগুলেটর নির্মাণ এবং খাল দুটিসহ শাখা খাল পুনঃখননের পরিকল্পনা করা হয়। এ প্রকল্পে রহমত খালের ভাটিতে লক্ষীপুরের মোজ্জার হাটে একটি রেগুলেটর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নোয়াখালী খালের প্রস্তাবিত রেগুলেটর নির্মাণ এবং খাল পুনঃখননের কাজ আজ পর্যন্ত করা হয়নি। ওয়াপদা খালটি বেগমগঞ্জের চৌমুহনী রেল স্টেশনের প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে আটিয়া বাড়ী রেলওয়ে ব্রীজটি ওয়াপদা খাল এবং নোয়াখালী খালের সংযোগ স্থানে খালের উজান হিসাবে চিহ্নিত। উজান হতে খালের দক্ষিণে মেঘনা নদী পর্যন্ত নোয়াখালী খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৬ কিলোমিটার। সেখান থেকে দক্ষিণে ভাটি পর্যন্ত উজানের অনেকগুলো খালসহ ভাটি অঞ্চলের বিভিন্ন পোল্ডারের খাল গুলো নোয়াখালী খালে পতিত হয়েছে। জেলা সদরসহ সুধারাম, কোম্পানীগঞ্জ ও বেগমগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য খালটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পলি মাটিতে নোয়াখালী খালের এক বিরাট অংশ বিশেষ করে মাঝামাঝি এবং ভাটির অংশ বিশেষ ভরাট হয়ে গেছে। এ কারণে খালের পানি নিষ্কাশন মতা দারুণভাবে লোপ পাওয়ায় নোয়াখালীর উপকূলের ব্যাপক এলাকা জলাবদ্ধতায় প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে সমগ্র চাটখিল, বেগমগঞ্জ ও সদরের মধ্য ও পূর্বাঞ্চল খুবই মারাত্মক আকার ধারণ করছে। সুধারাম থানার সোন্দলপুর, নেয়াজপুর, নরোত্তমপুর, ঘোষবাগ, বাটাইয়া এবং চাপরাশির হাটের ব্যাপক জমি সারাবছর পানিতে তলিয়ে থাকে। এজন্য এ অঞ্চলের মানুষগুলোকে দীর্ঘদিন থেকে খাদ্যাভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। কোন কোন এলাকার মানুষজন জায়গা জমি থাকা সত্ত্বেও মুটে মজুরী করে অমানবিক জীবনের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র অসহায়ের মত দিন কাটাচ্ছে। ১৯৮২-৮৩ এবং ১৯৮৮-৮৯ সালে অপরিকল্পিতভাবে কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পের অধীনের এ খালের কিছু পুনঃখননের কাজ হাতে নেয়া হয়। কিন্তু এলাকাবাসীর মতে এতে সময় এবং বিপুল অর্থ ও গমের অপচয় ছাড়া আর কিছুই হয়নি। এখন দিন দিন এর অবস্থা আরও অবনতি হচ্ছে। ভাটিতে কোন রেগুলেটর নির্মিত না হওয়ার ফলে খালের বিরাট অংশ পলিমাটিতে ভরাট হয়ে যায় এবং সময়ে সময়ে প্রচন্ডভাবে জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে চলেছে। এদিকে সুধারাম, বেগমগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জের এ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরিপ ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে পোল্ডার ৫৯/১ এ এবং ৫৯/১ বি বেড়ী বাঁধের সংযোগস্থল সোনাপুর এলাকার দেিণ কমপে ১৫ কিলোমিটার ভাটিতে গাংচিলে বড় আকারের একটি রেগুলেটর নির্মাণ পোল্ডার ৫৯/৩ বি এবং ৫৯/৩ সি সংযোগ বেড়ী বাঁধসহ কোজার ড্যাম নির্মাণ এবং প্রয়োজনীয় লুপ-কাট সহ ৩০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার খাল পুনঃখননের প্রস্তাব করে নোয়াখালী খাল পুনঃখনন এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প তৈরী করে। কিন্তু এ প্রকল্পটি আজ অব্দি বাস্তবায়িত না হওয়ায় নোয়াখালী উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এককালে নোয়াখালী খাল ছিলো প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা একটি বহমান নদী। মাঝি-মাল্লাদের ভাটিয়ালী সুরের ধ্বনীতে মানুষের মন জুড়িয়ে যেতো। রং-বেরংয়ের পাল তোলা নৌকার সারি ছুটে যেত এর বুক চিরে। দুর দূরান্তের পণ্যবাহী বজরা চলাচল করত এ খালে। কিন্তু বিগত যৌবনা নিস্তরঙ্গ জলকন্যার সেই রূপ এখন কেবলই ধূসর স্মৃতি হয়ে জেগে আছে। বর্ষাকালে এ খালে জোয়ারভাটা হত, শোঁ শোঁ শব্দে উঁটু হয়ে ধেয়ে আসত স্রোত। অথচ আজ জোয়ারের পলি মাটিতে বিলীন হয়ে গেছে খালের অস্তিত্ব। নোয়াখালী খাল ভরাট হয়ে পড়ায় জেলার ছয়টি থানার মধ্যে হাতিয়া দ্বীপ ছাড়া সুধারাম, সেনবাগ, কোম্পানীগঞ্জ, বেগমগঞ্জ ও চাটখিলের প্রায় দু’শ কিঃ মিঃ বিস্তীর্ণ এলাকার পানি নিষ্কাশন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে পড়ে। আজ আর নোয়াখালী খালে জোয়ার আসে না, খাল দিয়ে পানি মেঘনা নদী হয়ে সমুদ্রে যায়না। শুষ্ক মৌসুমে পুরো খাল একেবার শুকিয়ে যায় আবার বর্ষা মৌসুমে পানিবন্দী অবস্থায় আটক থাকে। খালের মুখে একটি বড় আকারের রেগুলেটর নির্মাণ এবং খাল পুনঃখনন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেই আশা করা হচ্ছে জনগণের দুঃখ লাঘব হবে।
মুখ থুবড়ে পড়ে আছে নোয়াখালী সেচ প্রকল্প
স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের আমলে দফায় দফায় নানা আশ্বাস দিলেও আজ পর্যন্ত নোয়াখালী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের ৩৭০ বর্গমাইল এলাকা সেচ সুবিধা পাবে এবং প্রতি বছর ৫০ হাজার টন অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন সম্ভব হবে। স্বাধীনতা পরবর্তী এ পর্যন্ত হিসাবে টাকার অঙ্কে যা দাঁড়ায় দুই হাজার কোটি টাকা। এ এলাকার মূল ভূ-খন্ডকে রার জন্য লীপুরের চর রমনীমোহনে মেঘনা নদীর মোহনায় রহমতখালী খালের উপর রেগুলেটর তৈরী করা হয় ১৯৭২ সালে। রেগুলেটরের সাহায্যে প্রয়োজন মত পানি বের করা যায়। কিন্তু মেঘনার পানি খালে ঢোকার সুযোগ নেই।
বর্তমানে মেঘনা নদীতে লবণাক্ততা নেই। কিন্তু রেগুলেটরের সাহায্যে খালে পানি ঢোকার ব্যবস্থা না থাকায় শুকনো মৌসুমে নোয়াখালী ও লক্ষীপুর জেলায় সেচের জন্য পানি সংকট দেখা দেয়। এজন্য রহমতখালী রেগুলেটরে একটি 'নেভিগেশন লক গেইট’ নির্মাণ এবং কামতা খালের উপর একটি পাম্প হাউজ নির্মাণ করলে শুকনো মৌসুমে ৯২ হাজার একর জমিতে সেচ সুবিধা পাবে। এ প্রকল্পটি সেচ, পানি উন্নয়ন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন। কামতাখালের উপর পাম্প হাউস নির্মিত হলে ডাকাতিয়া নদীর পানি খালের মাধ্যমে ডাবল লিফটিং পদ্ধতিতে পাম্পের সাহায্যে প্রকল্প এলাকায় প্রবেশ করানো সম্ভব হবে। ১৯৯৭ সালের ২০ জুন লীপুর সরকারি কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় মাননীয় প্রধানমন্তী শেশখ হাসিনা নোয়াখালী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়ার পরও আজ পর্যন্ত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কোন লণ দেখা যায়নি।
প্রহর গুনছে ভাটি অঞ্চলের ৪০ লাখ মানুষঃ
একটি সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দূর্ভোগ মোচনের প্রহর গুনছে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চেলের ভাটি অঞ্চলের ৪০ লাখেরও অধিক মানুষ। ৫০ বছর ধরে সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের অভাবে এলাকাবাসীর ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। বঞ্চিত হয়েছে বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লার ৪০ লাখেরও অধিক মানুষ। জলাবদ্ধতার নির্মম দুর্ভোগের কারণে এ অঞ্চলে কৃষি ও শিল্প খাতে ব্যাপক কোন উন্নতি হয়নি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার এর কাজ শুরু করে। এর জন্য প্রাথমিক কাজ শুরুর জন্য টাকা বরাদ্দও হয়েছিল কিন্তু পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের সরকারগুলো মানুষের দাবির মুখে বেশ কয়েকবার কাজ শুরুর প্রক্রিয়া দেখালোও অজানা কারণে মাঝপথে ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে। বিভিন্ন সময়ে এর বিভিন্ন নামও দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর কোন কাজই হয়নি। ১৯৮০-৮১ সালে কামতা ও মজনাথ রেগুলেটর তৈরীর মাধ্যমে এলাকায় সেচ উন্নয়নের জন্য লীপুরের একটি পানি উন্নয়ন বিভাগীয় দফতর চালু করা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের কোন অর্থবহ ভূমিকা নেই। নাম পরিবর্তন করে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা জরিপের অজুহাতে স্বাভাবিক নিষ্কাশন ব্যবস্থায় খাদ্য কর্মসূচীর আওতায় যে সামান্য কিছু কাজ হাতে নেয়া হয়েছিলো তাও এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত চালু প্রকল্পগুলোর চেয়ে উক্ত প্রকল্পের এলাকাটির সম্পূর্ণ ভিন্নতর। ঢাকা থেকে ৭০/৮০ কিলোমিটার দূরে দেশের দণি-পূর্বাঞ্চলীয় বিস্তৃত মেঘনা নদী বিধৌত ও বঙ্গোপসাগরের মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত ব-দ্বীপমালা নিয়ে এ প্রকল্পটি তৈরী করা হয়। বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার ৪০ লাখেরও বেশী এ অঞ্চলের অধিবাসী। মেঘনা ও সাগর বিধৌত এ অঞ্চলের ভূমি অত্যন্ত উর্বর। পলি মাটি সমৃদ্ধ এ উর্বর অঞ্চলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি ফসল ফলে। রাসায়নিক সারের ব্যবহারও এ অঞ্চলে অনেক কম। পূর্বে মুহূরী সেচ প্রকল্প, পশ্চিমে চাঁদপুর সেচ প্রকল্প, দেিণ উপকূলীয় বাঁধ বেষ্টিত এলাকার চাষাবাদ এবং বসবাসযোগ্য ভূমির পরিমাণ প্রায় ছয় লাখ একর। জলাবদ্ধতা এবং বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস এ অঞ্চরের মানুষের অন্যতম সমস্যা। এ জন্য বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের ৪০ লাখের বেশী লোক দুর্ভোগ মোচনের প্রহর গুণছে এ সেচ প্রকল্প প্রত্য করার জন্য। চৌমুহনীর অনেক সড়ক পথে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে, যানজট ও সড়ক পথের চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যের কারণে এই নৌপথের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু একশ্রেণীর অবৈধ ব্যবসায়ী খালের দিকে তাদের ঘরগুলো সম্প্রসারণ করে পরিবহনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাব কেন্দ্রের সঙ্গে এই বিশাল অঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকার নৌযোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। যার কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ র্ববসা কেন্দ্রটির অস্তিত্ব মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। অন্যদিকে খালের উপর অবৈধভাবে দোকানপাট নির্মাণ এবং খালের উপর ছোট ছোট নীচু পোল নির্মাণসহ কোথাও কোথাও পানি চলাচল বন্ধ করে রাস্তা নির্মাণের কারণে বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশন দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে এ বিশাল এলাকার নিম্নাঞ্চলে প্লাবন দেখা দিচ্ছে। তিগ্রস্ত হচ্ছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রাস্তাঘাট। প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার একর জমির ফসল। চৌমুহনী বড় পুল এলাকাটি তিনটি খালের সংযোগস্থলে অবস্থিত। পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে চৌমুহনী-ফেণী খাল এবং উত্তরে চৌমুহনী- ছাতারপাইয়া খাল এবং দেিণ নোয়াখালী খাল। এই তিনটি খাল হচ্ছে বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। এই তিনটি খালের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে অসংখ্য শাখা খালের। বর্ষা মৌসুমে ফেণীসহ নোয়াখালীর পূর্বাঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের চাপ পড়ে উক্ত খালগুলোর উপর। উক্ত খালগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে লীপুরের রহমতআলী খালের। আবার রহমতখালী খালের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ রয়েছে মেঘনার সঙ্গে। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ খালগুলো অর্থাৎ ফেণী-চৌমুহনী-ছাতারপাইয়া ও চৌমুহনী নোয়াখালী খাল ভরাট কের অবৈধভাবে দোকানপাট বাড়িঘর গড়ে উঠেছে। ফলে ফেণী ও ছাতারপাইয়ার পানির চাপে বর্ষা মৌসুমের বেগমগঞ্জ ও সেনবাগ ডুবে যায়। ডুবে যায় হাজার হাজার একর জমির ফসল , বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট।
চৌমুহনী, ফেণী খালের পাশ দিয়ে চলে গেছে চৌমুহনী ফেণী সড়ক। কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি সেই খাল ভরাট করে খালের উপর পুল ও ইটভাটার রাস্তা করার কারণে চৌমুহনীর সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের নৌযোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
একসময় এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাকেন্দ্রের সঙ্গে সড়ক পথে যোগাযোগ ছাড়াও নৌ যোগাযোগের সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। সড়ক যোগাযোগের অব্যবস্থা সহ অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে ব্যবসায়ীরা সাধারণত নৌপথেই মালামাল পরিবহনের স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু খালের কারণে নৌপথ ব্যবহার বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এখন এই অবৈধ বাড়ীঘর ও খালের উপর রাস্তা অপসারণ করে নৌ চলাচলের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনলে চৌমুহনীসহ এ অঞ্চলের ব্যবসা কেন্দ্রগুলো চাঙ্গা হয়ে উঠবে। উপকৃত হবে নিম্নাঞ্চলের লাখ লাখ কৃষক, রা পাবে হাজার হাজার একর জমির ফসলাদি। প্রতিবছর সংস্কার করতে হবে না হাজার হাজার কিলোমিটার রাস্তাঘাট। এ ব্যাপারে জনগণ ও চৌমুহনীর ব্যবসায়ী মহল সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপরে কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জোরদাবি জানিয়েছে।

মুখ থুবড়ে পড়ে আছে নোয়াখালী সেচ প্রকল্প


মুখ থুবড়ে পড়ে আছে নোয়াখালী সেচ প্রকল্প
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ


ভাটির দেশ হিসাবে পরিচিত বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা পলিমাটি বিধৌত উর্বর কৃষি প্রধান এলাকা। এ উর্বর ভূমিকে সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগিয়ে কৃষি উৎপাদনে কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ আজ অবধি কেউ গ্রহণ করেনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় এ লক্ষ্যে কয়েকটি সেচ প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হলেও আজও সেগুলো তিমিরেই বন্দী হয়ে আছে। বিভিন্ন সরকারের আমলে দফায় দফায় নানান আশ্বাস দিলেও আজ পর্যন্ত নোয়াখালী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের ৩৭০ বর্গমাইল এলাকা সেচ সুবিধা পাবে এবং প্রতি বছর ৫০ হাজার টন অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন সম্ভব হবে বলে পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী এ পর্যন্ত হিসাবে টাকার অঙ্কে যা দাঁড়ায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকারও বেশী। এ এলাকার মূল ভূ-খন্ডকে রার জন্য লীপুরের চর রমনীমোহনে মেঘনা নদীর মোহনায় রহমতখালী খালের উপর রেগুলেটর তৈরী করা হয় ১৯৭২ সালে। রেগুলেটরের সাহায্যে প্রয়োজন মত পানি বের করা যায়। কিন্তু মেঘনার পানি খালে ঢোকার সুযোগ নেই।
বর্তমানে মেঘনা নদীতে লবণাক্ততা নেই। কিন্তু রেগুলেটরের সাহায্যে খালে পানি ঢোকার ব্যবস্থা না থাকায় শুকনো মৌসুমে নোয়াখালী ও লীপুর জেলায় সেচের জন্য পানি সংকট দেখা দেয়। এজন্য রহমতখালী রেগুলেটরে একটি 'নেভিগেশন লক গেইট’ নির্মাণ এবং কামতা খালের উপর একটি পাম্প হাউজ নির্মাণ করলে শুকনো মৌসুমে ৯২ হাজার একর জমিতে সেচ সুবিধা পাবে। এ প্রকল্পটি সেচ, পানি উন্নয়ন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন। কামতাখালের উপর পাম্প হাউস নির্মিত হলে ডাকাতিয়া নদীর পানি খালের মাধ্যমে ডাবল লিফটিং পদ্ধতিতে পাম্পের সাহায্যে প্রকল্প এলাকায় প্রবেশ করানো সম্ভব হবে। বিগত সব সরকার প্রধানরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন সময় এই সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দিলেও আজ পর্যন্ত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কোন লক্ষণ দেখা যায়নি।
এখনো একটি সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দূর্ভোগ মোচনের প্রহর গুনে যাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চেলের ভাটি অঞ্চলের ৪০ লাখেরও অধিক মানুষ। ৫০ বছর ধরে সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের অভাবে এলাকাবাসীর ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। বঞ্চিত হয়েছে বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লার ৪০ লাখেরও অধিক মানুষ। জলাবদ্ধতার নির্মম দুর্ভোগের কারণে এ অঞ্চলে কৃষি ও শিল্প খাতে ব্যাপক কোন উন্নতি হয়নি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার এর কাজ শুরু করে। এর জন্য প্রাথমিক কাজ শুরুর জন্য টাকা বরাদ্দও হয়েছিল কিন্তু পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের সরকারগুলো মানুষের দাবির মুখে বেশ কয়েকবার কাজ শুরুর প্রক্রিয়া দেখালোও অজানা কারণে মাঝপথে ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে। বিভিন্ন সময়ে এর বিভিন্ন নামও দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর কোন কাজই হয়নি। ১৯৮০-৮১ সালে কামতা ও মজনাঘাট রেগুলেটর তৈরীর মাধ্যমে এলাকায় সেচ উন্নয়নের জন্য লীপুরের একটি পানি উন্নয়ন বিভাগীয় দফতর চালু করা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের কোন অর্থবহ ভূমিকা নেই। নাম পরিবর্তন করে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা জরিপের অজুহাতে স্বাভাবিক নিষ্কাশন ব্যবস্থায় খাদ্য কর্মসূচীর আওতায় যে সামান্য কিছু কাজ হাতে নেয়া হয়েছিলো তাও এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত চালু প্রকল্পগুলোর চেয়ে উক্ত প্রকল্পের এলাকাটির সম্পূর্ণ ভিন্নতর। ঢাকা থেকে ৭০/৮০ কিলোমিটার ভাটিতে দেশের দণি-পূর্বাঞ্চলীয় বিস্তৃত মেঘনা নদী বিধৌত ও বঙ্গোপসাগরের মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত ব-দ্বীপমালা নিয়ে এ প্রকল্পটি তৈরী করা হয়। বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার ৪০ লাখেরও বেশী অধিবাসী এ অঞ্চলে বাস করে। এরা অধিকাংশই কৃষিজীবি। মেঘনা ও সাগর বিধৌত এ অঞ্চলের ভূমি অত্যন্ত উর্বর। পলি মাটি সমৃদ্ধ এ উর্বর অঞ্চলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি ফসল ফলে। পূর্বে মুহূরী সেচ প্রকল্প, পশ্চিমে চাঁদপুর সেচ প্রকল্প, দক্ষিণে উপকূলীয় বাঁধ বেষ্টিত এলাকার চাষাবাদ এবং বসবাসযোগ্য ভূমির পরিমাণ প্রায় ছয় লাখ একর। জলাবদ্ধতা এবং বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস এ অঞ্চলের মানুষের অন্যতম সমস্যা। এ জন্য বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের ৪০ লাখের বেশী লোক দুর্ভোগ মোচনের প্রহর গুনছে এ সেচ প্রকল্প প্রত্যক্ষ করার জন্য। চৌমুহনীর অনেক সড়ক পথে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে, সড়ক পথে মাল পরিবহনের খরচ অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে। এর কারণে এই নৌপথের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু একশ্রেণীর অবৈধ ব্যবসায়ী খালের দিকে তাদের ঘরগুলো সম্প্রসারণ করে পরিবহনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাব কেন্দ্রের সঙ্গে এই বিশাল অঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকার নৌযোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। যার কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা কেন্দ্রটির অস্তিত্ব মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। অন্যদিকে খালের উপর অবৈধভাবে দোকানপাট নির্মাণ এবং খালের উপর ছোট ছোট নীচু পোল নির্মাণসহ কোথাও কোথাও পানি চলাচল বন্ধ করে রাস্তা নির্মাণের কারণে বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশন দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে এ বিশাল এলাকার নিম্নাঞ্চলে প্লাবন দেখা দিচ্ছে। তিগ্রস্ত হচ্ছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রাস্তাঘাট। প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার একর জমির ফসল। চৌমুহনী বড় পুল এলাকাটি তিনটি খালের সংযোগস্থলে অবস্থিত। পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে চৌমুহনী-ফেণী খাল এবং উত্তরে চৌমুহনী- ছাতারপাইয়া খাল এবং দক্ষিণে নোয়াখালী খাল। এই তিনটি খাল হচ্ছে বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। এই তিনটি খালের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে অসংখ্য শাখা খালের। বর্ষা মৌসুমে ফেণীসহ নোয়াখালীর পূর্বাঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের চাপ পড়ে উক্ত খালগুলোর উপর। উক্ত খালগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে লক্ষীপুরের রহমতআলী খালের। আবার রহমতখালী খালের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ রয়েছে মেঘনার সঙ্গে। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ খালগুলো অর্থাৎ ফেণী-চৌমুহনী-ছাতারপাইয়া ও চৌমুহনী নোয়াখালী খাল ভরাট করে অবৈধভাবে দোকানপাট বাড়িঘর গড়ে উঠেছে। ফলে ফেণী ও ছাতারপাইয়ার পানির চাপে বর্ষা মৌসুমে বেগমগঞ্জ ও সেনবাগ ডুবে যায়। ডুবে যায় হাজার হাজার একর জমির ফসল, বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট।
চৌমুহনী, ফেণী খালের পাশ দিয়ে চলে গেছে চৌমুহনী ফেণী সড়ক। কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি সেই খাল ভরাট করে খালের উপর পুল ও ইটভাটার রাস্তা করার কারণে চৌমুহনীর সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের নৌযোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সোনাইমুড়ি থেকে চাটখিল রামগঞ্জ হয়ে মহেন্দ্র খালটির সংযোগ রয়েছে মেঘনার শাখা নদী ডাকাতিয়ার সাথে। এ শাখা খাল গুলোর জলপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে এবং সেচ সুবিধা বাড়ানোর লক্ষে 'নর্থ-সাউথ ইরিগেশান প্রজেক্ট' নামে স্বাধীনতার পর একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিলো। সে প্রকল্পটিও আজও আলোর মুখ দেখেনি।
একসময় চৌমুহনীর মত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাকেন্দ্রের সঙ্গে সড়ক পথে যোগাযোগ ছাড়াও নৌ যোগাযোগের সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। নৌপথে খরচ কম ও নানান সুবিধার কারণে ব্যবসায়ীরা সাধারণত নৌপথেই মালামাল পরিবহনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কিন্তু খালের অকার্যকরণের ফলে নৌপথ ব্যবহার বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এখন এই অবৈধ বাড়ীঘর ও খালের উপর রাস্তা অপসারণ করে নৌ চলাচলের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনলে চৌমুহনীসহ এ অঞ্চলের ব্যবসা কেন্দ্রগুলো চাঙ্গা হয়ে উঠবে। উপকৃত হবে নিম্নাঞ্চলের লাখ লাখ কৃষক, রক্ষা পাবে হাজার হাজার একর জমির ফসলাদি। প্রতিবছর সংস্কার করতে হবে না শত শত কিলোমিটার রাস্তাঘাট। এ ব্যাপারে জনগণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অসংখ্যবার আবেদন নিবেদন করলেও কোনো কার্যকর ফল পাওয়া যায়নি।

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ
গবেষক, গণমাধ্যম কর্মী
দৈনিক প্রথম আলো, ৩১ আগষ্ট, ২০০৮

জলাবদ্ধতায় নোয়াখালীর উন্নয়নে স্থবিরতা




জলাবদ্ধতায় নোয়াখালীর উন্নয়নে স্থবিরতা
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

জলাবদ্ধতার কারণে কৃষি ব্যবসা বানিজ্য সহ সার্বিক উন্নয়নে নোয়াখালীতে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এর জন্য নোয়াখালীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নোয়াখালী খাল দায়ি বলে সর্বস্তরের জনগণ এবং বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন। জল নিষ্কাশন যোগাযোগ সেচ ইত্যাকার সামগ্রিক প্রয়োজনে নোয়াখালী খালটি ছিলো এ অঞ্চলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ খালটি ছিলো মূলত: প্রবহমান একটি খরস্রোতা নদী। মেঘনার ডাকাতিয়া নামের শাখা নদী থেকে নানান ভাবে এঁকেবেঁকে নোয়াখালীর মধ্যদিয়ে দক্ষিণে সাগরে এসে মিশেছে। নোয়াখালী খাল হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের জনবসতির উপর এক ব্যাপক প্রভাব ফেলে আসছে। এ খালটিই ছিল একদিন নোয়াখালীর জনগণের জন্য স্বর্গীয় আর্শীবাদ। কিন্তু এ খালটি এখন উপকূলীয় এ জনগণের দুর্ভোগের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পলিমাটি সমৃদ্ধ নতুন ভূমি সাগর থেকে জেগে ওঠার ফলে সাগর যত দক্ষিণে সরে গেছে ততই উজানে এ খালের তলদেশে পলি জমে জমে ভরাট হয়ে গেছে। দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এ খাল সংস্কার করার কথা থাকলেও এর জন্য কেউ কখনো কোনো কার্যকর পদপে নেয়নি। ফলে এ অঞ্চলের অন্যতম সমস্যা জলাবদ্ধতার নির্মম শিকারে নিপতিত হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে বিপুল জনগোষ্ঠী। চীনের হোয়াংহো নদীকে যেমন চীনের দুঃখ বলা হয় তেমনি নোয়াখালী খালকে ‘নোয়াখালীর দুঃখ’ বলে অভিহিত করা হয়। নোয়াখালী খালটি ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে পানি নিষ্কাশনের কার্যকারিতা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। নোয়াখালী খালসহ জেলার বিভিন্ন সংযোগ খালগুলোও এভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। যার ফলে ব্যাপক জলাবদ্ধতার কারণে নোয়াখালী জেলাবাসীর জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। খালের মুখে পলি মাটি জমে বিপুল পরিমাণ আবাদী জমির চাষাবাদ সম্পূর্ণরুপে বন্ধ হয়ে গেছে। এজন্য প্রায় কয়েকশ’কোটি টাকার ফসল উৎপাদন থেকে জেলাবাসী বঞ্চিত হচ্ছে।
এ সমস্যা নিরসন করতে সত্তর দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন র্বোড একটি প্রকল্প হাতে নেয়। সে প্রকল্পে রহমত খাল এবং নোয়াখালী খালের ভাটিতে দুটি রেগুলেটর নির্মাণ এবং খালের ভাটিতে দুটি শাখা খাল পুনঃখননের পরিকল্পনা করা হয়। এ প্রকল্পে রহমত খালের ভাটিতে লীপুরের মোজ্জার হাটে একটি রেগুলেটর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নোয়াখালী খালের প্রস্তাবিত রেগুলেটর নির্মাণ এবং খাল পুনঃখননের কাজ আজ পর্যন্ত করা হয়নি। ওয়াপদা খালটি বেগমগঞ্জের চৌমুহনী রেল স্টেশনের প্রায় এক কিলোমিটার দেিণ আটিয়া বাড়ী রেলওয়ে ব্রীজটি ওয়াপদা খাল এবং নোয়াখালী খালের সংযোগ স্থানে খালের উজান হিসাবে চিহ্নিত। উজান হতে খালের দেিণ মেঘনা নদী পর্যন্ত নোয়াখালী খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৬ কিলোমিটার। সেখান থেকে দেিণ ভাটি পর্যন্ত উজানের অনেকগুলো খালসহ ভাটি অঞ্চলের বিভিন্ন পোল্ডারের খাল গুলো নোয়াখালী খালে এসে সংযুক্ত হয়েছে। জেলা সদরসহ সুধারাম, কোম্পানীগঞ্জ ও বেগমগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য খালটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পলি মাটিতে নোয়াখালী খালের এক বিরাট অংশ বিশেষ করে মাঝামাঝি এবং ভাটির অংশ বিশেষ ভরাট হয়ে গেছে। এ কারণে খালের পানি নিষ্কাশন মতা দারুণভাবে লোপ পাওয়ায় নোয়াখালীর উপকূলের ব্যাপক এলাকা জলাবদ্ধতায় প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে সমগ্র চাটখিল, বেগমগঞ্জ ও সদরের মধ্য ও পূর্বাঞ্চল খুবই মারাত্মক আকার ধারণ করছে। সুধারাম থানার সোন্দলপুর, নেয়াজপুর, নরোত্তমপুর, ঘোষবাগ, বাটাইয়া এবং চাপরাশির হাটের ব্যাপক জমি সারাবছর পানিতে তলিয়ে থাকে। এজন্য এ অঞ্চলের মানুষগুলোকে দীর্ঘদিন থেকে খাদ্যাভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে । কোন কোন এলাকার মানুষজন জায়গা জমি থাকা সত্ত্বেও মুটে মজুরী করে অমানবিক জীবনের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে অসহায়ের মত দিন কাটাচ্ছে। এসব এলাকায় সরজমিনে গেলে দেখা যাবে ভরা চাষের মৌসুমেও গ্রামের পর গ্রামগুলো নীরব নিস্তব্ধ হয়ে আছে। আশির দশক থেকে এপর্যন্ত বিভিন্ন সময় অপরিকল্পিতভাবে কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পের অধীনের এ খালের কিছু পুনঃখননের কাজ হাতে নেয়া হয়। কিন্তু এলাকাবাসীর মতে এতে সময় এবং বিপুল অর্থ ও গমের অপচয় ছাড়া আর কিছুই হয়নি। এখন দিন দিন এর অবস্থা আরও অবনতি হচ্ছে। ভাটিতে কোন রেগুলেটর নির্মিত না হওয়ার ফলে খালের বিরাট অংশ পলিমাটিতে ভরাট হয়ে যায় এবং সময়ে সময়ে প্রচন্ডভাবে জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে চলেছে। এদিকে সুধারাম, বেগমগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জের এ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরিপ ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে পোল্ডার ৫৯/১ এ এবং ৫৯/১ বি বেড়ী বাঁধের সংযোগস্থল সোনাপুর এলাকার দক্ষিণে কমপক্ষে ১৫ কিলোমিটার ভাটিতে গাংচিলে বড় আকারের একটি রেগুলেটর নির্মাণ পোল্ডার ৫৯/৩ বি এবং ৫৯/৩ সি সংযোগ বেড়ী বাঁধসহ কোজার ড্যাম নির্মাণ এবং প্রয়োজনীয় লুপ-কাট সহ ৩০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার খাল পুনঃখননের প্রস্তাব করে নোয়াখালী খাল পুনঃখনন এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প তৈরী করে। কিন্তু এ প্রকল্পটি আজ অব্দি বাস্তবায়িত না হওয়ায় নোয়াখালী উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এককালে নোয়াখালী খাল ছিলো প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা একটি বহমান নদী। মাঝি-মাল্লাদের ভাটিয়ালী সুরের ধ্বনীতে মানুষের মন জুড়িয়ে যেতো। রং-বেরংয়ের পাল তোলা নৌকার সারি ছুটে যেত এর বুক চিরে। দুর দূরান্তের পণ্যবাহী বজরা চলাচল করত এ খালে। কিন্তু বিগত যৌবনা নিস্তরঙ্গ জলকন্যার সেই রূপ এখন কেবলই ধূসর স্মৃতি হয়ে জেগে আছে। বর্ষাকালে এ খালে জোয়ারভাটা হত, শোঁ শোঁ শব্দে উঁটু হয়ে ধেয়ে আসত স্রোত। অথচ আজ জোয়ারের পলি মাটিতে বিলীন হয়ে গেছে খালের অস্তিত্ব। আবার মরার উপর খাড়ার ঘা হিসাবে উন্নয়নের নামে নীচু করে তৈরি করা হয়েছে অনেক গুলো সেতু। সে সেতুর নীচ দিয়ে এখন কোনো নৌকা যেতে পারেনা। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে নৗ যোগাযোগ বেকার হয়ে পড়েছে ল ল মাঝি মাল্লার। নোয়াখালী খাল ভরাট হয়ে পড়ায় জেলার হাতিয়া দ্বীপ ছাড়া সমগ্র জেলার প্রায় দু’শ কিঃ মিঃ বিস্তীর্ণ পানি নিষ্কাশনের পথ গুলো সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে পড়ে। নোয়াখালীর চরাঞ্চলে যেখানে কোনোদিন জলাবদ্ধতা ছিলোনা সে সব এলাকাতেও জরাবদ্ধতার তীব্র প্রকোপ শুরু হয়েছে। সেখানে প্রভাবশালীরা প্রবহমান খালে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছে। নিস্তেজ হয়ে পড়েছে পানি প্রবাহ। আজ আর নোয়াখালী খালে জোয়ার আসে না, খাল দিয়ে পানি মেঘনা নদী হয়ে সমুদ্রে যায়না। শুষ্ক মৌসুমে পুরো খাল একেবার শুকিয়ে যায় আবার বর্ষা মৌসুমে পানিবন্দী অবস্থায় আটক থাকে। খালের মুখে একটি বড় আকারের রেগুলেটর নির্মাণ এবং খাল পুনঃখনন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেই আশা করা হচ্ছে জনগণের দুঃখ লাঘব হবে।
এদিকে নোয়াখালী শহরের জলাবদ্ধতা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তা ঘাট সহ শহরের অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। এর কারণে শহরবাসীর দুর্ভোগও চরমে উঠেছে। নোয়াখালী শহরের পানি নিষ্কাষনের ব্যবস্থা এখন একটি ট্যকনিক্যাল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ শহরের পানি নিষ্কাষনের যায়গাগুলো চিহ্নিতকরণ নানান প্রতিকুলোতার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে। শহরের পানি মূলত: বিভিন্ন দিকদিয়ে নোয়াখালী খালে গিয়ে পড়ে। এখন সে খালটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শহরের পানি নিষ্কাষনেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। শহরের মাঝামাঝি গুপ্তাংক থেকে হরিণারায়ণ পুর হয়ে ছাগল মারা খাল, বক্সিমিজির পোল থেকে পশ্চিমে মালেক খাল, উত্তরদিকে পুলিশ লাইনের পাশ দিয়ে গাবুয়া খাল মুখী নালাগুলো কিছু অবিবেচক মানুষের কর্মকান্ডে দৃশ্যত: প্রায় বিলিন হয়ে গেছে। সেখানে রাস্তা, বাড়িঘর ও দোকানপাট নির্মানের কারণে জলাবদ্ধতা প্রকট রুপ ধারণ করেছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতে শহর পানিতে থৈ থৈ করে। হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায় পাড়া মহল্লা। নষ্ট হয় রাস্তাঘাট সহ অবকাঠামো। ক্ষতি হয় কোটি কোটি টাকার।
মূল নোয়াখালী শহর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে পঞ্চাশের দশকে মাইজদিতে নোয়াখালী শহর স্থানান্তরিত করা হয়। এ শহরে নোয়াখালীর প্রাচীন ঐতিহ্যের কিছুই নেই। বসবাসের জন্য একটি নিরাপদ শহর হিসাবে সর্বত্র সুপরিচিত । এখন এটি একটি সুন্দর মনোরম শান্ত বর্ধিষ্ণু শহর হিসাবে গড়ে উঠছে। ভৌগোলিক দিক দিয়েও এর গুরুত্ব বাড়ছে। শহরের জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসন করতে পারলে শহরটি দক্ষিণ পূর্ব বাংলার একটি অনিন্দ্য সুন্দর পর্যটন নগরী হিসাবে গড়ে উঠতে পারে।

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ
গবেষক, গণমাধ্যম কর্মী

পরিবেশের পরিবর্তন, নোয়াখালীর জন্য সুসংবাদ !




পরিবেশের পরিবর্তন, নোয়াখালীর জন্য সুসংবাদ !মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

গত কয় বছর ধরে বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে পরিবেশ বিপর্যয়ের নানান আশঙ্কার কথা শুনা যাচ্ছে। তাঁরা বলছেন, পৃথিবীতে নেমে আসছে মারাত্মক দুর্যোগ। উষ্ণ হয়ে উঠছে পৃথিবী, ঝড় ঝঞ্ঝা জলোচ্ছাস বেড়ে যাচ্ছে, মানুষের রোগশোক বাড়ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ খবর হলো বায়ুমন্ডল উত্তপ্ত হওয়ার কারনে সাগর ফুলে ফেঁপে উঠছে। ফলে সাগর পাড়ের দেশগুলো ডুবে যাবে। ডুবে যাবে সে দেশের মানুষ আর প্রতিবেশ। সব চেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল।
গত ২৭জুলাই ‘০৮ দৈনিক প্রথমআলোতেই পাশাপাশি দুটি ভিন্ন ধর্মী লেখা ছাপা হয়। ‘রক্তে জন্ম পানিতে মরণ’ এবং ‘না, বাংলাদেশ তলিয়ে যাবেনা’ শিরোনামে যথাক্রমে বৃটিশ সাংবাদিক জোহান হারি ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড:এম,এইচ,খান এ দু’টি প্রবন্ধ রচনা করেন। প্রথম জন আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশ আগামী শতাব্দীতে লোনা জলে ডুবে যাবে। অন্যজন শুনিয়েছেন আশার বাণী। যাঁরা উপকূলে বংশপরম্পরায় বাস করে আসছেন, এলাকার মানুষের সাথে থেকে যাঁরা নীবিড়ভাবে কাজ করেন, এখানের বৈচিত্র্যময় আবহাওয়া পরিবেশকে যেভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারেন, অনুভব করেন। হঠাৎ করে এসে কেউ তা ধরতে পারার কথা নয়। প্রকৃতির মত বড় বিজ্ঞান আর কিছু হতে পারেনা। আথচ আমরা প্রায় ক্ষেত্রে এ বিজ্ঞানকেই পাশ কাটিয়ে যাই।
শত বছর ধরে নোয়াখালীর উপকূল ভাঙ্গা গড়ার খেলায় মত্ত। প্রকৃতির এ অনবদ্য খেলায় কিছু এলাকার ভূমি ভেঙ্গে ভেঙ্গে সাগরে হারিয়ে গেছে। পঞ্চাশের দশকে হাজার বছরের সমৃদ্ধ নোয়াখালী শহর সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায় সাগর গর্ভে। তখন নোয়াখালী শহর অস্থায়ী ভাবে স্থানান্তরিত করা হয় দশ কিলোমিটার উত্তরে মাইজদীতে। সাগরের তখনো রুদ্র রুক্ষ রোষ। তখন আনেকেরই আশঙ্কা ছিলো মাইজদীও নদীতে ভেঙ্গে যাবে। বিকল্প শহর হিসাবে তখন বিবেচনায় রাখা হয়েছিলো বেগমগঞ্জ ও ফেণীকে। ফেণী তখন নোয়াখালীর সাবডিভিশান। চল্লিশের দশকে বৃটিশ আমলে নোয়াখালীকে সাগর থেকে রক্ষা করার জন্য সে সময়ের এক তরুন মাইনিং ইঞ্জিনিয়র ওবায়দুল্লা ইঞ্জিনিয়র স্থানীয় মানুষদের সম্পৃক্ত করে স্বেচ্ছাশ্রমে সাগর আর প্রচন্ড ক্ষরস্রোতা মেঘনার মোহনায় ঠিক সাগরের উপর দিয়েই অবিশ্বাস্য ভাবে একটি বাঁধ তৈরী করে ছিলেন। সফলও হয়েছিলেন। পরবর্তীতে সে বাঁধ ওবায়দুল্লা ইঞ্জিনিয়র বাঁধ হিসাবে খ্যাতি লাভ করে। এলাকায় সে তরুন এখন কিংবদন্তিতে পরিনত হয়ে আছেন। সে সময়ের শিশু কিশোর এখন বয়:বৃদ্ধ অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাবে যাঁরা আবেগআপ্লুত হয়ে সে সাগর রুখে দেয়ার বিরত্বের কাহিনী বর্ণনা করবেন। সে বাঁধ দেয়ার ফলে সাগর শান্ত হয়। থেমে যায় ভাঙ্গন। কিন্তু অন্য এক উপসর্গ দেখা দেয়। মোহনার যে অংশে বাঁধ দেয়া হয়েছিলো সেখান দিয়ে বর্ষার উজানের পানি স্বাভাবিক ভাবে আর ভাটিতে যেতে পারছিলোনা। ফলে বেগমগঞ্জ সহ ব্যাপক এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। সেখানে কোনো ফসল হচ্ছিলোনা। কৃষকরা ক্ষেপে গিয়ে দলবদ্ধ হয়ে এক সময় সে বাঁধ কেটে দেয়। বাঁধ দেয়ার ফলে ধীরেধীরে দক্ষিণে যে পলি জমতে শুরু করেছিলো তা বাধাগ্রস্ত হয়। আবার ভাঙ্গতে থাকে গড়ে উঠা চর । এক সময় ভাঙ্গন এসে থমকে যায় বর্তমান নোয়াখালী সদর মাইজদী শহর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে সোনাপুরে। সে বাঁধের অভিজ্ঞতা থেকে ষাটের দশকে নোয়াখালীতে মেঘনার মোহনায় পর পর দুটি বাঁধ নির্মত হয়। একটি হয় বর্তমান নোয়াখালী সদরের দক্ষিণে আর একটি লক্ষীপুরের রামগতিতে। যথাক্রমে যা ওয়াবদা বাঁধ এবং তোহা বাঁধ হিসাবে পরিচিত। এর ফলে সাগরে পলি জমতে শুরু করে। সৃষ্টি হয় নতুন চর। মাত্র ষাট সত্তর বছর আগে যে সাগর এসে ঠেকেছিলো সোনাপুরে নতুন চর দেয়ার ফলে সে সাগর চলে গেছে সত্তর আশি কিলোমিটার দক্ষিণে। চোখের পলকে যেন এ ভাঙ্গাগড়ার খেলা হয়ে গেলো। সাগর থেকে এখনো নতুন নতুন চর জেগে উঠছে। প্রায় নব্বই বর্গকিলোমিটারের বয়ার চরটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে সাগর থেকে জাগতে শুরু করে। সে চর নিয়ে রক্তারক্তিও কম হয়নি। নোয়াখালী চর উন্নয়ন সংস্থা সেখানে ভূমিহীনদের খাসজমি বন্দোবস্ত দিয়েছে। ভূমিহীনরা এখন সেখানে উৎপাদন করছেন নানান ফসল। সরজমিনে সাগর মোহনায় গেলে যে কেউ দেখতে পাবেন, কি অবিশ্বাস্য ভাবে দক্ষিণে ভেসে উঠছে চরগুলো। ষাটের দশকে নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপের দক্ষিণে দূর সমুদ্রে ভেসে উঠেছিলো নিঝুম দ্বীপ। বর্তমানে সে দ্বীপটি পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এক সময় তরঙ্গবিক্ষুব্ধ উর্মিমালা ভেঙ্গে যেতে হতো নিঝুম দ্বীপে। এখন সে দ্বীপে হাতিয়ার জাহাজমারা হয়ে বন্দরটিলা নামের খেয়া পেরিয়ে সহজে যাওয়া যায়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, দীর্ঘদিন সে এলাকায় যারা প্রতিনিয়ত যাতায়ত করেছেন, তাঁদের কাছে এ সব কিছু বুক ভরে যাওয়া আশা জাগানিয়া প্রকৃতির এক অনন্য চমক ছাড়া আর কিছুই নয়। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের কারনে এ তথ্যগুলো পেতে আমাদের অনেক সহজ হয়েছে। ইন্টারনেটে গুগলআর্থে সার্চ করে যে কেউ দেখতে পাবেন নোয়াখালীর উপকূলে কি বিপুল পরিমান ভূমি জেগে উঠছে। ভূমি ও পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করছে এমন একটি সংস্থা ‘সেন্টার ফর এনভারমেন্ট এন্ড জিয়োগ্রাফিক্যাল ইন্ফরমেশন্স সার্ভিসেস’ এর মতে আগামী পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের উপকূলে প্রায় একহাজার বর্গ কিলোমিটার ভূমি সাগর থেকে জেগে উঠবে। বলা বাহুল্য এগুলোর প্রায় সবটাই হবে নোয়াখালীর উপকূলে। উক্ত সংস্থার অন্যতম গবেষক ও নদী বিশেষজ্ঞ মমিনুল হক গত ৩১জুলাই বিবিসির সাথে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, হিমালয়ে উৎপন্ন নদীগুলো প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টন পলি মাটি বয়ে আনছে। এর পরিমান প্রায় এক বিলিয়ন টন। এর ফলে প্রতি বছর কুড়ি বর্গ কিলোমিটার করে ভূমি উপকূলে যোগ হচ্ছে। জলবায়ু উষ্ণতার কারনে সমুদ্রোপকূলীয় ভূমিগুলো যে ডুবে যাবার আশঙ্কা বিজ্ঞানীরা করছেন সে সাথে বাংলাদেশও যে ডুবে যাবে সে আশঙ্কা খন্ডন করে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাগরের উচ্চতা বেড়ে যাবে ঠিক কিন্তু বাংলাদেশের উপকূল ডুবে যাবার আশংকা নেই। বরং ঘটনা ঘটবে তার উল্টো। বরং সেখানে জমি গুলো আরো উঁচু হবে এবং সাগরে জাগবে নতুন নতুন চর। এর কারণ হিসাবে তিনি জানান, ’৫৭ সালে ও ’৬৩ সালে যে দুটি বাঁধ নির্মিত হয়েছে তার ফলে এখানে ভূমি গঠন দ্রুত হয়েছে এবং ’৫০সালে আসামে একটি প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প হয়েছিলো তখন সেখানে ব্যাপক ভূমিধ্বস হয়। সে ভূমি ব্রহ্মপুত্র হয়ে বাংলাদেশের সাগর মোহনায় পলিমাটি হয়ে জমা হচ্ছে। এ পলি জমা অবশ্য শত শত বছর ধরেই চলছে এবং এখনও তা অব্যাহত আছে। গত পঞ্চাশ বছর তা কিছুটা দ্রুত গতিতে হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবীর মানুষ নানান দুর্যোগের মধ্যে পড়বেন । বাংলাদেশেও এ থেকে বাদ যাবেনা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনেকটা শাপে বর হওয়ার মত। হিমালয়ের বরফ গলে লক্ষ লক্ষ টন পলি বয়ে নিয়ে আসবে বাংলাদেশের উপকূলে। হাজার বছর ধরেই এ প্রকৃয়া অবশ্য চলে আসছে। এখন তা কিছুটা দ্রুত হবে। কারণ হিমালয়ের বরফ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মেই গলছে। সৃষ্টি হচ্ছে অনন্ত জলধারা। হাজার বছর ধরে সে জলধারা ব্রহ্মপুত্র হয়ে পদ্মা মেঘনা যমুনার মিলিত স্রোতধারায় বাংলাদেশের উপর দিয়ে এসে মিলছে সাগরে। সাথে নিয়ে আসছে বিপুল পরিমানে পলি মাটি। এই জলধারা এবং পলি মাটি মিলেমিশে উপকূল জুড়ে চলছে এক অদ্ভুত প্রাকৃতিক রুপান্তর। বেড়ে যাচ্ছে নোয়াখালীর আয়তন। বাড়ছে বাংলাদেশ।
প্রশ্ন হলো যে বিপুল ভূমি নোয়াখালীর উপকূলে জেগে উঠছে তা কি ভাবে আমরা কাজে লাগাবো। নতুন যে চর জাগছে আমাদের জন্য তা প্রকৃতির এক অপার দান। যেখানে একটুকরো জমির জন্য মানুষ হাপিত্তেস করছে সেখানে এত ভূমি যে উঠছে, তা সংরক্ষনের জন্য কোনো ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনা আমরা করতে পারছিনা। এর জন্য কিছু নীতিমালা আছে মাত্র। কিন্তু দৃশ্যত: কোনো কার্যকারিতা তেমন নেই। নতুন জমি দেখলেই জোতদার ভূমি দস্যুদের লেলিহান জ্বিহ্বা লোভে চক চক করে উঠে। তারা হামলে পড়ে সে জমির উপর। খামচে ধরে খাবলে খায় সে জমি। সরকারের প্রথমেই এ ভূমি দস্যুদের নিষ্কৃয় করা হবে প্রথম কাজ। আবিলম্বে টাস্কফোর্স গঠন করে দস্যুদের হাত থেকে এ ভূমিগুলো রক্ষা করতে হবে। এ ভূমিগুলো দেশের অন্যান্য ভুমি গঠন থেকে কিছুটা ভিন্ন। পলিমাটি সমৃদ্ধ অত্যন্ত উর্বর এ ভূমিতে সামান্য চাষেই বিপুল ফসল উৎপন্ন হয়। অপরদিকে দেশে ভূমিহীনের সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এরা অধিকাংশই কৃষক। এ ভূমিহীন কৃষকদের কাজে লাগিয়ে এ ভূমিকে সর্বোচ্চভাবে কী ভাবে কাজে লাগাতে পারি তার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরী।

Research: নোয়াখালীর চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত দরিদ্র নারীদের আর্থ-সামাজিক ও জীবন যাত্রার মানোন্নয়নের পন্থা উদ্ভাবন


গবেষণার উপস্থাপনা

নোয়াখালীর চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত
দরিদ্র নারীদের আর্থ-সামাজিক ও জীবন যাত্রার
মানোন্নয়নের পন্থা উদ্ভাবন।


-গবেষক-
: মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ :


গবেষণার শিরনাম :- নোয়াখালীর চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত দরিদ্র নারীদের
আর্থ-সামাজিক ও জীবন যাত্রার মানোন্নয়নের পন্থা উদ্ভাবন

গবেষণা টিমে যাঁরা রয়েছেন :

১. মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ প্রধান গবেষক
২. নিলুফার আক্তার গবেষণা সহযোগী
৩. শাহানা আক্তার শাহিন এনিমেটর
৪. খালেদা আক্তার লাবনী এনিমেটর
৫. মারজাহান সুলতানা মার্জু এনিমেটর
৬. আনোয়ারা বেগম আর্জু এনিমেটর
৭. নাসির উদ্দিন শাহ্ নয়ন এনিমেটর


গবেষণার মেয়াদকাল : ৬ (ছয়) মাস।
১ জুলাই, ২০০৪ইং থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৪ইং

পদ্ধতি : অংশগ্রণমূলক কর্ম গবেষণা

সহায়তায় : রিসার্র্চ ইনিশিয়েটিভস্, বাংলাদেশ (রিইব)




গবেষণার সার সংক্ষেপ

নোয়াখালী জেলার উপকূলীয় অঞ্চলের নির্দিষ্ট কিছু এলাকার নারীরা চাটাই শিল্পের সাথে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত রয়েছে। বিশেষ করে জেলার দক্ষিণাঞ্চলের সুধারাম থানার সাহেবের হাট, চর মটুয়া, খলিফার হাট, এওজবালিয়া, ইসলামগঞ্জসহ এক ব্যাপক এলাকায় এগুলো তৈরী হয়। নিম্ন আয়ের দরিদ্র প্রতিটি ঘরে ঘরেই নারীরা এই শিল্পের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। উপকূলীয় পলিমাটি সমৃদ্ধ এই এলাকায় চাটাই পাতা প্রচুর উৎপন্ন হয়। কোন রকম চাষাবাদ ছাড়াই নীচু জমিতে এই পাতার গাছ আপনাতেই জন্মে। স্থানীয় ভাষায় এটি হোগলা নামেই পরিচিত। হোগলা পাতা দিয়ে সাধারণতঃ চাটাই বা বিছানা তৈরী হয়। এই চাটাই নিম্ন আয়ের জনগণ ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বিছানা হিসেবে ব্যবহার করে। তাছাড়া ঘরের ছাউনী, বেড়া ও ফসল রাখার টুকরী বানানোর জন্যও এই পাতা ব্যবহার করা হয়। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ শিল্পও বটে। হোগলা পাতা দিয়ে চাটাই তৈরীর কাজ প্রধানতঃ নারীরাই করে থাকে। নোয়াখালীর এই অঞ্চল থেকে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার চাটাই তৈরী হয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানী হয়। সিলেট, ব্রাক্ষ্মনবাড়ীয়া, রংপুর, ঢাকা, চট্রগ্রামসহ দেশের উত্তরাংশে বছরে কয়েক কোটি টাকার চাটাই চালান হয়। সে সব অঞ্চলে এর ব্যাপক বাজার রয়েছে। আনুমানিক চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার নারী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রতিদিন নিরলস ভাবে চাটাই তৈরী করে থাকে। কিন্তু মধ্যস্বত্ব ভোগী দালাল, ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা নারীদের এই অক্লান্ত শ্রমকে জিম্মি করে রেখেছে। তাদের শ্রমের কোন মূল্য দেয়া হয় না। নানান কৌশলে নাম মাত্র মূল্যে ফড়িয়ারা নারীদের কাছ থেকে চাটাই কিনে নেয়। ফলে উৎপাদনকারী বিপুল সংখ্যক নারীরা তাদের শ্রম মূল্য না পেয়ে অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। এই নারীদের অধিকাংশই সম্পূর্ণ নিরর। এর ফলে একদিকে যেমন এই সম্ভাবনাময় শিল্পটি দিন দিন ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে অন্যদিকে এই নারীদেরও জীবনের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

চাটাই সাধারণতঃ নিম্ন আয়ের মানুষ বেশী ব্যবহার করে। দামেও এটি অপেক্ষাকৃত কম। তাই একে গরিবের বিছানা নামে অনেকেই অবহিত করেন। বিভিন্ন চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এ শিল্পটির বিপুল সম্ভাবনার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এর কোনে প্রসার ঘটেনি।

এই পরিপ্রেক্ষিতে চাটাই শিল্পের সঙ্গে জড়িত জনগোষ্ঠীর উপর ব্যাপক গবেষণার লক্ষে রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস্ বাংলাদেশ (রিইব) এর সহযোগিতায় নোয়াখালী সুধারাম উপজেলার কয়টি প্রত্যন্ত গ্রামে এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কি করে এই নারীদের আরো বেশী সহযোগিতা করা যায় এবং মধ্যস্বত্বভোগী দালাল চক্র থেকে উদ্ধার করে আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো যায় সে উদ্দেশ্যেই মূলত এ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।

নোয়াখালীর এ গ্রামগুলো হোগলা শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে পর্যায়ক্রমে এ শিল্পটি বিকাশ লাভ করেছে। এক সময় মেঘনার মোহনায় এই এলাকা গুলো ভেঙ্গে গেলে পলিমাটি সমৃদ্ধ পয়স্তি নীচু জমিতে হোগলা গাছ উৎপন্ন হয়েছে। সাধারনতঃ নতুন জেগে উঠা জমিতে প্রকৃতিকভাবেই এ গাছ বংশ বিস্তার করে। এলাকার মানুষ প্রায় বিনা শ্রমেই এগুলো পেয়ে থাকে। যার কারণে ঐ এলাকায় হোগলা পাতা দিয়ে তৈরী চাটাই শিল্প প্রসার লাভ করেছে। এ পেশায় সাধারনতঃ ঐ এলাকার নারীরাই জড়িত। এ শিল্পটি নারী শ্রমিকদের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। এ এলাকায় এমন কোন বাড়ী পাওয়া যাবেনা যেখানে নারীরা একাজে নেই। এই নারীরা অসম্ভব পরিশ্রমী ও নিবেদিত প্রাণ। শ্রমজীবি গ্রামীণ এ নারীরা অবদান রাখছে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে। এটি একটি চলমান শিল্প এবং ক্ষয়িষ্ণুও নয়। কিন্তু এর পেছনের সুদক্ষ কারিগর নারীরা রয়ে গেছে বঞ্চিত শোষিত ও ঋণগ্রস্থু হয়ে। দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম করেও এরা এদের অভাব ঘুচাতে পারেনি

ছয় মাস ব্যাপী এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে সম্পূর্ণ অংশগ্রহণমূলক কর্ম গবেষণা পদ্ধতিতে। কর্ম এলাকায় পাঁচটি গ্রুপ করে পাঁচ জন এনিমেটর গবেষণার কাজ পরিচালনা করেছেন। এ গবেষণায় মূলত: গবেষক ছিলেন চাটাই শিল্পের নারীরা । ১ জুলাই ২০০৪ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০০৪ পর্যন্ত ৬ মাস ব্যাপী ছিলো এর সময়কাল। গবেষণা করতে গিয়ে প্রথমে এনিমেটর টিমকে এক কঠিন বাস্তবতার মধ্যে পড়তে হয়েছিলো। গ্রামের নারীরা প্রথমে দাবি করে বসেছিলো তাদেরকে রিলিফ বা অনুদান দিতে হবে। অন্তত: প্রতিশ্রুতি দেওয়া জন্য তারা পিড়াপিড়ি করে। কিন্তু এ গবেষণাটি ছিলো গতানুগতিক গবেষণার বাইরে একেবারেই ভিন্ন আঙ্গিকের। কোনো রকম প্রতিশ্রুতিতে গবেষণা টিমটি ছিলো একেবারেই অপরাগ। দুটি যায়গা থেকে এদের চলেও আসতে হয়েছে। পরে যখন গবেষণা শুরু হলো তখন এই নারীরা বুঝতে পারলেন দান খয়রাত অনুদান কি ভাবে এদেরকে অবদমিত করে রেখেছে। তাঁরা বুঝতে পারলেন তাঁদের ভিতরে রয়েছে এক অসাধারণ ক্ষমতা। এর সঠিক ব্যবহারেই তাদের অবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন একটু সহায়ক পরিবেশ। শত শত বছর ধরে নারীদের মধ্যে যে কুসংস্কার পাথর চাপা দিয়ে অচলায়তন সৃষ্টি করে রেখেছে তা সামান্য এ কয় দিনের গবেষণায় সরানো সম্ভব নয়। তবে এ গবেষণার ফলে তাদের চিন্তা চেতনায় আশাপ্রদ পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে।

এ গবেষণাটি পরিচালনা করার জন্য মূল গবেষক, একজন সহযোগী গবেষক ও পাঁচ জন মাঠ পর্যাযের এনিমেটর বা উজ্জীবক নিয়ে সাত জনের একটি দল গঠন করা হয়েছিলো। এর জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চলের পাঁচটি স্পট ঠিক করা হয়। সে নির্দিষ্ট এলাকার নারীদের নিয়েই এ গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত ভাবে গবেষক নারীরা দলীয় অলোচনা ও গবেষণায় অংশগ্রহন করে। এরপর মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতার আলোকে গষেণার পুরো টিমকে নিয়ে নিয়মিত সাপ্তাহিক কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। এ কর্মশালার মাধ্যমে গবেষণার অগ্রগতি পর্যালোচনা ও পরবর্তী সপ্তাহের কার্যক্রমের পরিকল্পনা করা হয়েছ। প্রতি সপ্তাহে এনিমেটররা প্রত্যেকে একটি করে রিপোর্ট করেছেন এবং সব শেষে রিপোর্ট গুলো সমন্বয় করে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরী করা হয়েছে। গবেষণাকালে এলাকার বিভিন্ন মানুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়াও শতাধিক ষ্টিল ছবিও তোলা হয়েছে।



নোয়াখালীর চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত দরিদ্র নারীদের
আর্থ-সামাজিক ও জীবন যাত্রার মানোন্নয়নের পন্থা উদ্ভাবন

গবেষণার উপস্থাপনা

গবেষণার ধারণা :

নোয়াখালী জেলার দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের প্রায় লক্ষাধিক দরিদ্র নারীরা চাটাই শিল্পের সাথে প্রত্যভাবে জড়িত রয়েছে। যুগ যুগ ধরে এ শিল্পের সাথে জড়িত থেকেও তারা তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেনি। অনেক নারী ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। ঋণ এবং অনুদান সর্বদা এদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এই দরিদ্র নারীদের আর্থ-সামাজিক জীবন ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে আছে। দিন ও রাত তাদের জীবন একই চক্রের মধ্যে ঘূর্ণিয়মান হচ্ছে। এ নারীরা অসম্ভব পরিশ্রমী ও নিবেদিত প্রাণ। শ্রমজীবী এ গ্রামীণ নারীরা অবদান রাখছেন দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে। অথচ এ শিল্পটি ক্ষয়িষ্ণুও নয়। এর পিছনের কারিগর নারীরা রয়ে গেছে বঞ্চিত শোষিত ঋণগ্রস্থ হয়ে। তাদের জীবনে কোন বিনোদন নেই, খুব স্বপ্নচারীও তারা নয়। শুধু আকুতি রয়েছে একটু বেঁচে থাকার এদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সরকারী বেসরকারী কোন পর্যায়ে থেকেই এ যাবত কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। চিন্তা চেতনার দিক দিয়েও এরা এক বৈচিত্র্যহীন জীবনের ঘানি টেনে যাচ্ছে। অথচ এ নারীদের মধ্যেই নিহিত রয়েছে অসাধারণ এক সম্ভাবনার পথ।

চাটাই পাতা বা হোগলা পাতা

যে গাছের পাতা দিয়ে চাটাই তৈরী করা হয়, স্থানীয় ভাষায় একে হোগলা পাতা বলা হয়। এটি তৃণ জাতীয় উদ্ভিদ। উপকূলীয় পলিমাটিতে এ গাছটি আপনাতেই জন্মে। এ গাছটি লম্বায় ১২ থেকে ১৫ ফুট হয়ে থাকে। নোয়াখালীতে প্রায় ৩২৫ হেক্টর জমিতে হোগলা পাতার চাষ হয়। প্রায় এক ইঞ্চি ব্যাসার্ধের ত্রিকোণাকৃতি মাংসল পাতা এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ পাতা দিয়ে চাটাই বা বিছানা তৈরী করলে বিছানাটি নরম ও আরামপ্রদ হয়। নিম্নবিত্ত ও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ এটি ব্যবহার করে। তাছাড়াও দড়ি, ঘর তৈরী, বেড়া, তাজা ফল মূল বা কোন কিছু পরিবহনের জন্য টুকরী বানিয়ে এর ব্যাপক ব্যবহার হয়। এটি ১০০% পরিবেশ সম্মত। ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে সারা বছরই এটি জন্মে। গবেষণা প্রকল্প এলাকার প্রতিটি গ্রামেই হোগলা পাতার বন পরিদৃষ্ট হয়।


বাজার ব্যবস্থাপনা :

হোগলা পাতা দিয়ে উৎপাদিত পণ্য বিশেষ করে আভ্যন্তরীণ বাজারেই সরবরাহ করা হয়। নোয়াখালীর কয়টি গ্রামীণ বাজার এ পণ্যের জন্য বিখ্যাত। প্রতি সপ্তাহে লক্ষ লক্ষ টাকার পণ্য এখানে বেচা কেনা হয়। এখান থেকে ব্যবসায়ীরা সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করে। বিদেশের বাজারে হোগলা পাতা দিয়ে তৈরী উচ্চমানের হস্তশিল্প তৈরী করে দু’একটি প্রতিষ্ঠান রপ্তানী করছে। বিদেশে এর ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এর প্রসার এখনো তেমন ঘটেনি। স্থানীয়ভাবে ফড়িয়ারা এর বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। গ্রামীণ নারীদের কাছ থেকে খুবই অল্প দামে কিনে এরা অধিক মুনাফায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে। এর জন্য গড়ে উঠেছে একটি ফড়িয়া চক্র। চাটাই শিল্পের নারীদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে এ চক্রটি মুনাফা লুফে নিচ্ছে।



অমিত সম্ভাবনা

হোগলা পাতার এ শিল্পটির রয়েছে এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা। এ থেকে পরিবেশ সম্মত পণ্য উৎপাদন হয় বিধায় এর ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে। তবে প্রচারের অভাবে এটি তেমন বিকাশ লাভ করেনি। ছোট বিছানা, নামাজের মাদুর, কুশন, ঝুড়ি, টুপি, ছোট ব্যাগ, টুকরী, ঘরের নানান ধরণের ওয়ালম্যাট, এল্টিক্স, হাত পাখা ইত্যাদি নানান পণ্য এ থেকে উৎপাদিত হতে পারে। বিদেশেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। নানান গবেষণার মাধ্যমে এর বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার খুঁজে বের করে একে আরো জনপ্রিয় করে গড়ে তোলা সম্ভব। এছাড়া মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়াদের কাছ থেকে এর বাজারকে উদ্ধার করে গ্রামীণ নারীদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে এ শিল্পের সাথে জড়িত নারীরা প্রত্যক্ষ উপকৃত হবে।






গবেষণার লক্ষ্য :

 চাটাই শিল্পে জড়িত নারীদের জীবন চিত্র তুলে ধরা।
 এদের শ্রমের ধরণ ও জীবিকার সংকটের কারণ অনুসন্ধান করা।
 প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সংকটের কারণ ও তার সমাধানের পন্থার আলোকে পুনরায় গবেষণা করা যায় কিনা সে বিষয়ে দিক নির্দেশনা প্রদান করা।



সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য :

চাটাই শিল্পে জড়িত নারীদের জীবনমান উন্নয়ন এবং তাদের দুর্ভোগ নিরসনের পন্থা উদ্ভাবন।

গবেষণার স্থান :

নোয়াখালী জেলার সদর থানার দক্ষিণাঞ্চলের এওজবালিয়া, কালাদরাপ, চরমটুয়া ইউনিয়নের কয়টি গ্রামে এ গবেষণার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। নোয়াখালী শহর থেকে এ স্থানগুলো ১৫ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এ সব স্থানগুলো ঘন বসতিপূর্ণ নীবিড় নিভৃত গ্রাম। শহর থেকে এ গ্রামগুলোতে যোগাযোগের ব্যবস্থা মোটামুটি ভাল। যাতায়াতের জন্য রিক্সা, টেম্পু, টেক্সি ইত্যাদি রয়েছে। এলাকাটি মূলতঃ কৃষি প্রধান। এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। ধান এখানকার প্রধান কৃষি পণ্য। মৌসুমে এখানে প্রচুর শাক সব্জী উৎপন্ন হয়। গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হোগলা পাতার বন।


সরণি-১: গবেষণা সম্পর্কে অংশগ্রহণকারী নারীদের ধারণা :

১ আমরা কয়েকজন মিলে কথা বলছি, এটাই হলো গবেষণা।
২ কয়েক জন মিলে যুক্তি করে কিছু করাই গবেষণা।
৩ নতুন কিছু তৈরী করা।
৪ অজানা বিষয়কে জানা।
৫ যেমন আমরা চাটাই বানাই, কাটি, বাছাই করি, তারপর বানাই, বিক্রি করি। আবার আপনি এটা নিয়ে কথা বলেন, এটাই হলো গবেষণা।



যেভাবে গবেষণা পরিচালিত হয়েছে :

এই গবেষণাটি সম্পূর্ণ অংশগ্রহণমূলক কর্ম গবেষণার পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়েছে। এটি অংশগ্রহণমূলক কর্ম গবেষণা। এ গবেষণা পদ্ধতিটিতে কোনো ভাবেই গতানুগতিক অন্যান্য গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। এ গবেষণাটি পরিচালনার জন্য মূল গবেষক, একজন সহযোগী গবেষক ও পাঁচ জন মাঠ পর্যায়ের এনিমেটর বা উজ্জীবক নিয়ে সাত জনের একটি দল গঠন করা হয়েছে। এর জন্য নোয়াখালীর সদর উপজেলার নির্দিষ্ট অঞ্চলের পাঁচটি স্পট ঠিক করা হয়েছে। সে নির্দিষ্ট এলাকার নারীদেরনিয়েই এ গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। এগুলো হলো :

১. জুম্মারাগো বাড়ী,
কালাদরাপ ইউনিয়ন,
রাহামুড়ী তালুক গ্রাম।
২. দপ্তরী বাড়ী,
পূর্ব এওজবালিয়া ইউনিয়ন,
সাহেবের হাট।
৩. রুহুল আমিনের বাড়ী,
বরাইপুর গ্রাম ,
কালাদরাপ ইউনিয়ন ।
৪. আবুল খায়ের মিয়ার বাড়ী,
পূর্ব এওজবালিয়া,
শান্তিনগর গ্রাম।
৫. আকরাম খাঁ মেম্বার বাড়ী,
এওজবালিয়া গ্রাম।

এই পাঁচটি স্পটে নারীদের নিয়ে গবেষক দল গঠন করা হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে গবেষক নারীরা দলীয় আলোচনা ও গবেষণায় অংশগ্রহণ করে। গবেষণার উজ্জীবকরা প্রতিটি দলে সমন্বয়কের কাজ করেছেন মাত্র। এক একটি স্পটের এক একটি দলে একজন উজ্জীবক দায়িত্ব পালন করেছেন। গবেষকরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের বিষয় সমস্যা আলোচনা করেছেন। এক একদিন এক এক বিষয় নিয়ে তারা গবেষণা করেছেন। সেই গবেষণার বিষয়গুলো উজ্জীবকরা গভীর পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং এর ভিত্তিতে রিপোর্ট তৈরী করা হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে মাঠের অভিজ্ঞতার আলোকে গবেষণার পুরো টিম নিয়ে সপ্তাহে একদিনের কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। এ কর্মশালাগুলোতে সকলে মাঠের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন এবং এ থেকে পরবর্তী সপ্তাহের জন্য কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়। মাঠ পর্যায়ের ভুলত্রু টি সুবিধা অসুবিধা গুলো আলোচনা করে এর মাধ্যমে একটি নতুন দিক নির্দেশনা খুঁজে পাওয়া গেছে। এর ভিত্তিতে সকলেই সাপ্তাহিক রিপোর্ট ও মাস শেষে মাসিক রিপোর্ট / প্রতিবেদন তৈরী করেছেন। এ থেকে গবেষণার একটি সুশৃঙ্খল ডকুমেন্টশন করা হয়েছে। গবেষণা চলাকালীন বিভিন্ন ফটোগ্রাফ নেয়া হয়েছে। এ পদ্ধতিতে গবেষণা করার ফলে এমন কতগুলো বিষয় উঠে এসেছে যা আগে ধারণা করা হয়নি। প্রথম প্রথম মাঠ পর্যায়ে গবেষণা দল গঠন করতে গিয়ে গ্রামের অনেকেই জানতে চেয়েছেন ঋণ কিংবা রিলিফ দেওয়া হবে কিনা। গবেষণা টিমের প থেকে এর ফলে একটি কঠিন বাস্তবতার মধ্যেই পড়তে হয়েছিলো। ঋণ ও রিলিফ / অনুদান ছাড়া অনেকে কথা বলতেই নারাজ ছিলো। দুই জায়গা থেকে গবেষণা টিমকে ফিরেও আসতে হয়েছে। পরে যখন গবেষণা শুরু হলো তখন গ্রামীণ এই নারীরা আশ্চর্যরকম ভাবে পরিবর্তিত হয়ে উঠলো। অনেকেই নিজেদেরকে খুঁজে পেতে লাগলো। এরা এখন খুবই আগ্রহী ও উৎসুক। তারা ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছে রিলিফ অনুদান দিয়ে নয়, নিজের ভিতরের মতা ও শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব।

গবেষণা যেভাবে সমন্বয় করা হয়েছে :

প্রধান গবেষক পুরো গবেষণার সমন্বয় ও পরিচালনা করেছেন। গবেষণার সকল বিষয় পরিচালনার জন্য তিনি একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। পাঁচ জন এনিমেটরের প্রতি সপ্তাহের মাঠের জরিপ ও গবেষণা নিয়ে সকলের রিপোর্ট জমা হলে গবেষক ও সহযোগী গবেষক এ নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন। গবেষণার ধারাবাহিকতা রার জন্য সকলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা গ্রহন করা হয়। প্রতি সপ্তাহের কর্মশালায় প্রধান গবেষক কর্মশালার পরিচালনা করেন এবং প্রধান সমন্বয়ক হিসাবে কাজ করেন। এনিমেটররা যেহেতু অধিকাংশই নারী সংবাদকর্মী সুতরাং গ্রামের নারীদের সাথে এরা সহজে মিশে দ্রুত কাজ করতে পেরেছেন। মাঠ পর্যায়ে এ বিষয়ে প্রাথমিক সাফল্য পাওয়া গেছে। গ্রামীণ নারীরাও খুব সহজে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এদের সাথে মিশে গেছেন। নারীরা তাদের কষ্ট বেদনার কথা উজাড় করে বলতে পেরেছেন। অংশগ্রহণমূলক কর্ম গবেষণার জন্য যা অত্যন্ত জরুরী। গবেষক এনিমেরদের জন্য এটি স্পর্শকাতর হৃদয়ঘন উষ্ণ অভিজ্ঞতা। প্রাথমিকভাবে গবেষণায় নারীদের সম্বন্ধে যে বিষয়গুলো জানা গেছে তা হলো-



তারা যে চিন্তাগুলো ধারণ করে আছে

 নারীরা খুবই সীমিত গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ।
 পুরুষরাই শ্রেষ্ঠ। নারীদের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার রয়েছে পুরুষদের।
 নারীদের সৃষ্টি হয়েছে পুরুষদের সেবা দাসী হিসাবে।
 পুরুষের বাম পাঁজড় থেকে নারীর সৃষ্টি।
 রান্না বান্না ঘর সংসারের কাজ করবে নারীরা।
 পুরুষ এবং নারী উভয়ে ভিন্ন ভিন্ন জাত।
 পুরুষের পায়ের নীচে নারীর বেহেস্ত। স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর বেহেস্ত।

অর্থনৈতিক পর্যবেণ :

 এলাকার ৮০% নারীরা চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত।
 চাটাই বিক্রির টাকা এরা স্বামীদের হাতে তুলে দেয়।
 ৯৫% পরিবার খুবই নিম্ন আয়ের।
 উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পায় না।
 ৬০% নারী কোন না কোন ভাবে ঋণগ্রস্থ।
 সিলেট, রংপুর, চট্টগ্রাম ইত্যাদি অঞ্চলে চাটাইয়ের প্রচুর চাহিদ রয়েছে।
সামাজিক পরিবেশ, স্বাস্থ্য :

 ৯৮% পরিবার খোলা পায়খানা ব্যবহার করে।
 ১০০% পরিবার পুকুর ব্যবহার করে।
 কবিরাজ, হাতুড়ে ডাক্তার, গ্রাম ডাক্তার, তাবিজ তুমার ইত্যাদির উপর ভরসা করে।
 নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা নেই। শিক্ষার হার খুবই কম।

চাটাই তৈরী :

 চাটাই তৈরীতে নারীরা বিভিন্ন সময় নির্ধারণ করে থাকে।
 রাত্রীতে চাঁদের আলোতে চাটাই তৈরী হয়।
 ভোরের কুয়াশা, ভেজা আবহাওয়ায়, ছায়াযুক্ত মাটিতে নারীরা চাটাই তৈরী করে।
 বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে চাটাই তৈরীর হাতে খড়ি হয়।
 চাটাই ছাড়া অন্য কোন পণ্য তৈরী করেনা।
 ফড়িয়ারা চাটাইয়ের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
 কুটির শিল্পের কোন প্রশিণ এরা পায়নি।
 প্রশিক্ষণ পেলে অনেক নতুন বৈচিত্র্যময় পণ্য তৈরী করা সম্ভব, যা দেশে ও বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে।








সুখ যন্ত্রণার অনুকাব্য :

বৈচিত্র্যহীন জীবনের ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যে বসবাস করলেও প্রাণের স্বপ্নিল কষ্ট যন্ত্রণাগুলো কাজের ছন্দে ছন্দে মাঝে মাঝে ধরা দেয়। শিক্ষাদীক্ষাহীন গ্রাম্য নারীদের কন্ঠ থেকে আপনাতে উচ্চারিত হয় ওদের জীবনের নানান অনুসঙ্গ। বিছানা বা চাটাই নিয়ে প্রসঙ্গ কাব্য।
বিছানা দিলাম যেমন তেমন
বালিশ দিমু না
দমকার বিছানা
বিছাই দিলে বেজার হইও না।

নানান প্রতিকূলতার মাঝেও চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারীরা নিত্য স্মরণ করে তার সৃষ্টিকর্তাকে। সকল আপদে বিপদে সৃষ্টিকর্তাই একমাত্র ভরসা।
মাছে করে পানির আশা
পঙ্খী করে ডালের আশা।
আমি করি কিসের আশা?
আমি করি মাওলার আশা।

সোহাগ ভালবাসা রাগ অনুরাগে নিজের পছন্দের মানুষকে আগলে রাখে। তার জন্য সব কিছু উজাড় করে দেয়।
যার লাই যার হরান কান্দে
উদার করি ভাত রান্দে।

ঋণ গ্রহণ করতে নারীদের পড়তে হয় নানান বিড়ম্বনার মধ্যে। এছাড়াও অযাচিত ঋণের কুফল সম্পর্কেও ওদের অজানা নয়। দুর্ভোগের কথা কাব্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়-

হাঁইটতে হাঁইটতে নালা
খাইতে খাইতে গলা।

বর্ষাকালে মাটি জায়গা মত থাকেনা। ধুয়ে চলে যায়। মানুষের আশাগুলোও বিলীন হয়ে যায়।

আল্লা নেয় তোড়ে
বান্দার আশা গড়ে (নালা নর্দমা)।


প্রয়োজনের সময় সকল অনুভূতি বিসর্জন দিতে হয় তাদের

গিন (ঘৃণা) হালাইছি গড়ে (নালা নর্দমা)
ভাত হালাইছি নড়ে (নাড়ীতে)।


প্রিয় মানুষ প্রিয় মুখ যখন দূরে চলে যায়। চলে যায় মনের আড়ালে। হঠাৎ করে যখন এসে কখনো দেখা দেয়, অভিযোগের সুরে বলেন-

দিন গেল কাল গেলো
উক্কুত্ (হঠাত্) করি মনে পড়লো।


গবেষণার গতিময়তা :

গবেষণার ছক বাঁধা হয়েছিলো মাত্র ৬ মাসের জন্য। কাজ করতে গিয়ে কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, যে এটি ঠিক গতানুগতিক গবেষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। একটি সুদূর প্রসারী কর্মসূচীতে এটিকে সংযোজন করতে হবে। গবেষণার একদিকে যেমন রয়েছে চাটাই শিল্পে দরিদ্র নারীদের সামাজিক পরিবর্তনের ভাবনা তেমনি এই সম্ভাবনাময় উপেতি একটি গ্রামীণ শিল্পের প্রসারের রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। যার অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে অসীম। তাই এ বিষয়ে গবেষণা টিমটিও গভীর আগ্রহে ও উৎসুক্য নিয়ে নিরলস কাজ করে গেছে। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা এবং দেশাত্ববোধ এর প্রধান অবলম্বন।


সরণি-২ : জেলা- নোয়াখালী, উপজেলা- সদর।

এনিমেটরদের নাম ইউনিয়ন গ্রামের নাম বাড়ীর নাম অংশগ্রহণকারী পরিবারের সংখ্যা
নারীরসংখ্যা


আনোয়ারা বেগম (আরজু) ৭নং এওজবালিয়া এওজবালিয়া আকরাম খাঁ
মেম্বারের বাড়ী ৩০জন ২২টি

খালেদা আক্তার (লাবনী) ৭নং এওজবালিয়া পূর্ব এওজবালিয়া হাবিল খান
দপ্তরী বাড়ী ২৫জন ১০টি

মারজাহান সুলতানা (মার্জু) ৭নং এওজবালিয়া শান্তিনগর আবুল খায়ের
মিয়ার বাড়ী ২৫জন ১৬টি

শাহানা আক্তার (শাহীন) ৮নং কালাদরাপ রাহামুড়ী তালুক দাঁড়ী ব্যাপারী
জুম্মারাগো বাড়ী ৩০জন ১৩টি

নাছির উদ্দিন শাহ্ (নয়ন) ৮নং কালাদরাপ পশ্চিম বারাহীপুর রুহুল আমিনের বাড়ী
(আরাফাত চাটাই প্রকল্প) ২৫জন ১০টি


যেসব নারীরা চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত :

গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্নবিত্ত পরিবারের একদল তৃণমূল নারী মূলতঃ এ চাটাই শিল্পের ধারক ও বাহক। দৈনন্দিন জীবনের বেঁচে যাওয়া সময়টুকুকে তারা ব্যয় করেন চাটাই বুননের কাজে। চাটাই তৈরীর কাজ তাদের জন্য খুব একটা কঠিন না হলেও বেশ পরিশ্রমের ও সময় সাপে। এ সব নারীরা ঘর সংসার সামলানোর পরেও পরিবারের বাড়তি কিছু রোজগারের প্রত্যাশায় হোগলা পাতার নান্দনিক রূপ দিয়ে তৈরী করেন চাটাই শিল্প। এখানকার নারীরা তাদে পূর্ব পুরুষ থেকে প্রাপ্ত পেশাটিকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। কোনো রকম প্রশিণ ছাড়াই তারা কাজগুলো শিখেছেন বংশ পরম্পরায়।


চাটাই শিল্পীদের আর্থসামাজিক অবস্থা :

চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারীরা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত। অনেকের নূন আনতে পান্তা ফুরায়। একটি মানুষের বেঁচে থাকার যে পাঁচটি মৌলিক অধিকার রয়েছে তা আদৌ এদের জীবনে অর্জিত হচ্ছে কি কিনা এ নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথাও নেই। এদের বেশীর ভাগই অর্থনৈতিক দৈন্যতার কারণে উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত। বঞ্চিত স্বাস্থ্য সেবা থেকে। নানা রকম কুসংস্কার ও নিজস্ব ধ্যান-ধারণাকে মনের মাঝে পোষণ করে আছেন এরা। গবেষণার মাধ্যমে তারা তাদের নানান সমস্যাগুলো নিজেরাই চিহ্নিত করতে পেরেছেন। এ সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণকল্পে বিভিন্ন পর্যায়ে মতবিণিময় কালে তাদের মেধা ও মননশীলতার পরিচ্ছন্ন একটি দিক প্রকাশ পায়। বোঝা যায় উপযুক্ত শিক্ষা পেলে এরা নিজেদেরকে নুতন ভাবে আবিষ্কার করার সুযোগ পাবেন।

শিক্ষা ব্যবস্থা :

এক সময় নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে এরা রক্ষণশীল মনোভাব পোষণ করলেও বর্তমান যুগের বিবর্তনের এ কালকে তারা অস্বীকার করছে না। কিন্তু দারিদ্র .এদের শিক্ষার সু-কোমল বৃত্তিকে দাবিয়ে রেখেছে। তবে এ বিষয়ে তাদের ইচ্ছা শক্তিরও বিকাশ ঘটেনি। আবার কেউ কেউ অভাবের দোহাইকে প্রশ্রয় না দিয়ে তাদের ছেলে মেয়েদেরকে ক্রমশ: স্কুলগামী করে তুলেছে। তারা বুঝতে শিখেছে শুধু অর্থ নয় ভাগ্য উন্নয়নের জন্য শিক্ষারও প্রয়োজন রয়েছে।

চিকিৎসা / স্বাস্থ্য সেবা :

এ এলাকার নারীদের অনেকেরই পুষ্টিহীনতায় ভরা জীর্ণশীর্ণ দেহ। অনেকেই ভুগছেন নানা রোগ শোকে। এর কারণ হিসাবে তারা তাদের নিত্য দিনের অভাব অনটনকে দায়ী করেছেন। দারিদ্র তাদেরকে যেমনি আবদ্ধ করে রেখেছে তেমনি আবদ্ধ করেছে রোগ বালাই। এখানকার এ জনগোষ্ঠীর জন্য এখানে নেই কোন চিকিৎসা কেন্দ্র। রোগ বালাই হলে তাদেরকে হতে হয় শহরমূখী। কিন্তু স্বল্প আয়ের এ মানুষগুলোর পে শহরে এসে ব্যয় বহুল চিকিৎসা গ্রহণ করা কোন রকম সম্ভব নয়। এ অবস্থায় তারা শরণাপন্ন হয় সনাতনী চিকিৎসা ব্যবস্থার। অর্থাৎ বাধ্য হয়ে তাদেরকে নির্ভর করতে হয় ঝাড় ফুঁক সহ নানা রকম কবিরাজি চিকিৎসায়। এ প্রসঙ্গে আলোচনা কালে এখানকার বয়স্ক জনেরা মনে করেন তাদের সময় চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকলেও এখনকার প্রজন্মের জন্য এখানে চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে উঠা খুবই জরুরী। বিয়ের পর থেকে সোমেনা খাতুন (৬০) চাটাই তৈরী করে আসছেন, বলেন, ‘‘বাবারে আঙ্গো দিন তো হারই গেছে অনগার হোলাহাইনের লাইতো এক্কান ডাক্তারখানা দরকার।’’ এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে স্থানীয় প্রতিনিধি সহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, এখানকার স্থানীয় কয়েকটি সমস্যার মধ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা প্রধান একটি সমস্যা। এতগুলো জনগোষ্ঠীর জন্য এখানে সরকারী বেসরকারীভাবে আজো গড়ে উঠেনি কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্র।


সরণি ৩: চাটাই শিল্পের নারীদের নিজেদের সম্পর্কে ধারণা


 আমরা সবাই চাটাই বানাতে পারি।
 বাচ্চা লালন পালন, নামায কালাম পড়া।
 গান গাওয়া, বিয়ের গান গাওয়া ইত্যাদিতে অভিজ্ঞ।
 সেলাই করতে পারি।
 নাচতে জানি।
 কুটির শিল্পের কাজ জানি।

বিনোদন :

একজন মানুষের বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে বিনোদন ব্যবস্থা একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। বর্তমান মিডিয়ার যুগে বিনোদনের নানা ব্যবস্থা থাকলেও এর কোনটিই এই সব তৃণমূল মানুষের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেনি। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোথাও কোথাও দু’একটি টেলিভিশন থাকলেও এটি পর্যাপ্ত নয়। কারণ রক্ষণশীল সমাজ ও পারিবারিক ব্যবস্থায় নারীদের পক্ষে লোকালয়ে গিয়ে বিনোদন উপভোগ করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। তাই তারা নিজেদের মধ্যে গল্প-গুজব, হাসি-ঠাট্টা করে সময় কাটান। তবে এই কথা সত্য যে, গ্রামীণ এমন কিছু সংস্কৃতি আছে যা অনেক পুরনো হলেও তা এদের আনন্দ দিয়ে থাকে। যেমন রেডিও’র গান, ক্যাসেটের গান, বিয়ের গান, জারী গান, শ্লোক, পুঁথি ইত্যাদি।

সরণি-৪: পুরুষদের সম্পর্কে নারীদের ধারণা :


 পুরুষ উপার্জন করে।
 বাজার করে
 শক্তি বেশি।
 সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
 সংসারের ভালোমন্দ দেখে।
 সন্তান জন্মদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, বাবা হয়।






হোগলা পাতার চাষ পদ্ধতি :

এ অঞ্চলে কবে কখন হোগলা পাতার উৎপত্তি হয় তার কোন সঠিক তথ্য স্থানীয় জনগণ জানাতে পারেনি। এ সম্পর্কিত কোন তথ্য স্থানীয় কৃষি বিভাগও জানাতে পারেনি। হোগলা পাতা এক ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট দশ বার ফুট লম্বা, চির সবুজ তৃণ জাতীয় উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘টাইফা ইলিফান্টেনা’ (Typha Elephantena).

প্রাকৃতিকভাবে এ হোগলা পাতার বন গড়ে উঠেছে। সাগর থেকে এক সময় চর জেগে উঠে। চরগুলো তখনো থাকে নীচু। এ অবস্থায় জোয়ারের পানিতে ভেসে আসে হোগলার বীজ। এ ভাবে নতুন হোগলার ঝাড় সৃষ্টির মাধ্যমে এ বনের উৎপত্তি হয়েছে। নদী বা খালের পাড়ে এবং পলিমাটি সমৃদ্ধ ভেজা মাটিতে হোগলা গাছ আপনাতেই জন্মায়। হোগলা পাতা দেখতে অনেকটা ত্রিকোণাকৃতির। পাতা উৎপাদনের জন্য কোন সেচ ব্যবস্থা নিড়ানী আগাছা দমন বা কীট নাশকের প্রয়োগের প্রয়োজন হয়না। এর বংশ বৃদ্ধি সাধারণতঃ বীজ বা গাছের মূলের সাহায্যে হয়ে থাকে।
হোগলা পাতা সাধারণতঃ কার্তিক অগ্রাহায়ন মাসে কাটা হয়। কাটার পর পাতাগুলো রোদে শুকিয়ে চাটাই বুননের উপযোগী করে তোলা হয়। হোগলা পাতা সাধারণতঃ দুই প্রকারের।

১. আউশ পাতা।
২. শাইল পাতা।
রোদে শুকানোর পর পাতাগুলো হলুদ আকার ধারণ করে। কার্তিক অগ্রহায়ন মাস ছাড়াও আষাঢ় শ্রাবণ মাসে একবার পাতাগুলো কাটা হয় যাতে অকেজো পাতাগুলো বাদ হয়ে নতুন পাতা গজায়।

প্রক্রিয়াজাতকরণ :
রোদে শুকানোর পর পাতাগুলোকে ধারালো ছুরি দিয়ে লম্বালম্বী ভাবে দুইভাগ করা হয়। দুইটি অংশ দিয়ে চাটাই তৈরী করা যায়। মাঝখান থেকে চিকন সুতার ন্যায় একটি আবরণ বের করা হয়। যা দিয়ে সিকা, দড়ি ইত্যাদি তৈরী করা যায়।

উৎপাদিত পণ্য :

হোগলা পাতা দিয়ে চাটাই তৈরীর পাশাপাশি হাত পাখা, ঝুড়ি, সিকা, বিড়া (স্থানীয় ভাষায় হোঁচ্ছা) দড়ি, টুকরি, পানের বাটা ইত্যাদি গৃহস্থালির ব্যবহার্য্য পণ্য তৈরী করা হয়।

ব্যবহার বিধি :

হোগলা পাতার চাটাই মুসলমানদের মসজিদ, মক্তব, মাদ্রাসা, বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া কোরবানের পশু জবাই করার পর মাংস কাটার কাজে ব্যবহার করা হয়। ব্যবহার করা হয় মৃত ব্যক্তির দেহ মোড়ানোর কাজে। শুধু যে মুসলমানরা ব্যবহার করে তা নয়, বিভিন্ন মন্দির ও গীর্জায় হোগলা পাতার চাটাই ব্যবহার করা হয়। তাছাড়াও নতুন দালান নির্মাণের এবং ছাদ ঢালাইয়ের সময় ব্যবহার করা হয়। ঘরের শোভা বর্ধনের লক্ষে বিভিন্ন নকশা খচিত করে চাটাই ব্যবহার করা হয়। গ্রামাঞ্চলে উননের ধোঁয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঘরের দমদমা (সিলিং) হিসাবে ব্যবহার করা হয়।




প্রাপ্তীর স্থান :

নোয়াখালীর সদর থানাধীন খলিফার হাট, বাঁধের হাট, ওদার হাট, এওজবালিয়া, বিনোদপুর এসব এলাকায় সাধারণতঃ হোগলা পাতা ব্যাপক হারে জন্মে। এ এলাকাগুলো হোগলা পাতা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন উৎপাদিত পণ্যের প্রাপ্তীর স্থান হিসাবে চিহ্নিত। এছাড়াও নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ উপকূলে হোগলা পাতা আপনাতেই জন্মে।

এ অঞ্চলের হোগলা পাতা শিল্পের প্রধান কেন্দ্রটি খলিফার হাটে গড়ে উঠেছে। সপ্তাহে রবি ও বুধবার এখানে হাট বসে। সে হাটের বিরাট একটি স্থান জুড়ে রয়েছে শুধুমাত্র হোগলা পাতা বেচা কেনার জন্য। এ ব্যবসা গড়ে উঠেছে কয়েকটি শ্রেণীর মধ্যে। একদল মাঠে গিয়ে গৃহস্থ কৃষকদের কাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করে। সে পাতা দিয়ে আঁটি বাঁধা হয়। পাতার মান অনুযায়ী আলাদা আলাদা করে আঁটি বাঁধা হয়। মান অনুযায়ী প্রতিটি আঁটির দামও হেরফের হয়। এবং ওসব আঁটির পাতা দিয়ে তৈরী চাটাইর দামেও হেরফের থাকে। সেগুলো চাটাই তৈরী করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন নারীদের কাছে। বেচা কেনার আর একটি মাধ্যম হচ্ছে ব্যবসায়ীরা হোগলা বনের মালিক থেকে বিভিন্ন মেয়াদে পুরো হোগলা বন কিনে নেয়। গ্রামের নারীরাই সাধারণতঃ চাটাই তৈরী করেন। সে চাটাই ফড়িয়ারা সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চালানের উদ্দেশ্যে জমা করে এবং তারাই এ চাটাই দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করে।

গবেষণা কালে জানা গেছে প্রতি হাটে এখান থেকে প্রায় দু’ থেকে তিন লক্ষ টাকার চাটাই ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ফরিদপুর সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি করা হয়। এ নিয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয় বছরে এর পরিমাণ প্রায় কোটি টাকার উপরে। হরিনারায়ণপুর রেল ষ্টেশন থেকেই সাধারণতঃ এগুলো ট্রেনে বোঝাই হয়।

বাজারজাত করণে ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য :

চাটাই শিল্পে বাজারজাত করণ তথা ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তিতে প্রধান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী হল ফড়িয়ারা। স্থানীয়ভাবে যারা দালাল নামে পরিচিত। চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত একজন নারী হোগলা পাতা কেনা থেকে শুরু করে যে পরিমাণ কায়িক শ্রম দিয়ে একটি চাটাই তৈরী করে, এ ফড়িয়াদের কারণে তারা তাদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। দেখা যায় একটা চাটাই তৈরী করতে প্রায় ৩০ টাকার পাতা কিনতে হয়। তার সাথে আছে তৈরী করা পর্যন্ত পুরো একদিনের শ্রম। শ্রমের বাজারের যার মূল্য সর্ব নিম্ন ৭৫ টাকা। কিন্তু দেখা যায় এভাবে তৈরীকৃত চাটাই যখন বাজারে আসে তখন ফড়িয়ারা এর দাম ধরে ২০ থেকে ৩০ টাকা। এ অবস্থায় দেখা যায় বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ফড়িয়ারাই দাম নির্ধারণ করে থাকে। ব্যাপারটি যে কারিগররা উপলব্ধি করতে পারে না তা নয়। কিন্তু অর্থনৈতিক টানা পোড়নের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে তারা এ সমস্যা গুলোকে স্বীকার করে নিচ্ছে। পক্ষান্তরে লাভবান হচ্ছে ফড়িয়ারা।





ফড়িয়াদের কাছ থেকে কিভাবে উত্তরণ করা যায় :

চাটাই শিল্পটি মূলতঃ একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা পেলে চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারীরা অর্থনৈতিক মুক্তিলাভ করবে। যদি তারা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করণের একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে তাহলে ফড়িয়া নামধারীর দুষ্ট চক্রের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। এতে করে তারা বিক্রয়মূল্য সরাসরি গ্রহণ করতে পারবে। তাদের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী বাজারজাত করণের লক্ষে বেসরকারী সংস্থা এন আর ডি এস (নোয়াখালী রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি) নোয়াখালীতে কুটির শিল্পীদের তৈরী বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর একটি প্রকল্প রয়েছে। তাঁরা হোগলা পাতা দিয়ে উৎপাদিত পণ্য দেশে বিদেশে বাজার করতে আগ্রহী। শুধু হোগলা পাতা দিয়েই এ এলাকায় রপ্তানীমূখী কুটির শিল্প গড়ে উঠতে পারে। শহর কেন্দ্রীক এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যাদের পক্ষে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারী পুরুষদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা বহুলাংশে সম্ভব হয়না। এ ক্ষেত্রে এ ধরণের গবেষণার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা যদি অনুঘটক হয়ে এদের তৈরী উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করণের সহযোগিতা করে তাহলে তারা বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠবেন এবং ফড়িয়াদের কাছ থেকে নিজেদেরকে রা করতে পারবেন। এভাবে নিজেরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন।

একজন নারী একটি চাটাই তৈরী করে বাড়ীর পুরুষ কর্তা অথবা কোন কিশোর কিশোরী কিংবা শিশুদেরকে দিয়ে বাজারে পাঠায়। সে শিশু কিশোর বা কিশোরীটি সেজে গুজে চাটাই নিয়ে বাজারে গিয়ে দাঁড়ায় তখনও সে জানেনা এ চাটাইটির ন্যায্য মূল্য কত আর এ না জানার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফড়িয়ারা কম দামে চাটাইটি কিনে নেয়। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায় শিশু কিশোররা চাটাই বিক্রি করার জন্য বাজারে আসে এবং তারাই আবার বাজার থেকে হোগলা পাতার আঁটি কিনে নিয়ে যায়। এই শিশু কিশোররা অনেকেই বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে। কিন্তু হাট বাজারের দিন তারা স্কুলে না গিয়ে এই চাটাই বিক্রির কাজে ব্যস্ত থাকে। সে সঙ্গে তারা বাড়ীর জন্য বাজার সদাই করে নিয়ে যায়। এদিকে এ সমস্ত হাট বাজার গুলোতে বিশেষ করে ডানিডা সহযোগিতায় নারীদের জন্য একটি পাকা ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিলো এখানে এসে নারীরা তাদের পণ্য বেচাকেনা করবেন। কিন্তু এ সেড গুলো প্রায় ফাঁকা থাকে। খলিফার হাটে বাজার কটি ও স্থানীয় একটি সংস্থার উদ্যোগে চাটাই তৈরীর কাজে জড়িত নারীদের জন্য আলাদা একটি প্লটের ব্যবস্থা থাকলেও সমাজের রক্ষণশীলতার বেড়াজালের কারণে নারীরা বাজার মুখো হয়না। আর হয়না বলেই বঞ্চিত হয় ন্যায্য মূল্য থেকে। এ ক্ষেত্রে নারীরা নিজেরা সংঘবদ্ধ হয়ে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। যেখানে ফড়িয়ারা ছাড়া পাইকারী ব্যবসায়ীরা এসে তাদের কাছ থেকে চাটাই ক্রয় করবে। এ ভাবে নারীদের নিজেদের নিয়ন্ত্রনে একটি বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।

চাটাই শিল্পী নারীদের ধ্যান ধারণা ও চিন্তা চেতনা :

চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারীরা অজ্ঞতা, অসচেতনতা, অশিক্ষা, ধর্মীয় গোড়ামী ইত্যাদির কারণে বিভিন্ন সনাতনী ধ্যান-ধারণা পোষণ করে আসছে। তবে তাদের মধ্যে জানার প্রবল ইচ্ছাশক্তি সম্পূর্ণভাবে বিরাজমান। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মত প্রকাশ করেন। তাঁরা মনে করেন, মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য এই যে, মানুষের বুদ্ধি, বিবেক আছে, আছে বিবেচনা বোধ। কিন্তু পশু পাখির মধ্যে এ গুণ গুলো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। মানুষ হিসাবে তাদের অধিকার সম্পর্কে চিন্তাগুলো খুব স্পষ্ট নয়। তাদের মতে, একজন মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য সরকার কর্তৃক সুযোগ সুবিধা গুলো হচ্ছে অধিকার।




কাজের মূল্যায়ন :

নিজেদের কাজের মূল্যায়নের ব্যাপারটি নিয়ে এসব নারীরা চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। একজন নারী শুধু কাজই করে যাবে, এমন একটি ধারণা পোষণ করে আছে তারা। এরা আরো মনে করেন, শুধুমাত্র পুরুষের সেবা করার জন্যই নারী জাতির জন্ম হয়েছে। গবেষণায় তারা উপলব্ধি করেন যে, কাজের মূল্যায়ন পাওয়া তাদের একটি ন্যায্য অধিকার। গ্রামের কয়েকজন পুরুষের সাথে নারীদের কাজের মূল্যায়ন সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করলে তারা স্বীকার করেন যে, নারীদের কাজের মূল্যায়ন করা উচিত। তারা বুঝতে শিখেছে পরিবারের উন্নয়নে নারীরাও ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। তোফায়েল আহমদ (৬০) পেশায় কৃষক, তিনি বলেন, ‘মায়েরা বেশি কাম কইত্তো, অন দেই হোলা মাইয়ার মায়েও বেশি কাম করে। আসলে ঘরের মইধ্যে মাইয়াগো কামও বেশি।’ তাঁর মতে, চাটাই বিক্রির সব টাকা চাটাই বুননকারীকেই দিতে হবে। কারণ এই টাকার হক তারই সবচেয়ে বেশি। প্রতি বছর এই এলাকায় প্রায় ১ কোটি টাকার চাটাই বেচাকেনা হয়।

চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারীদের ভাগ্য উন্নয়নে তারা কিভাবে স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে, ফড়িয়াদের কাছ থেকে উত্তরণের পথ কিভাবে তারা অধিকার করতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে তারা কিভাবে স্বয়ং সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে, শিশু ও বয়স্ক শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের ভাবনা ও করণীয় কি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলাপ হয় স্থানীয় প্রতিনিধি, বিভিন্ন পেশার লোক, গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারী ও পুরুষের সাথে।

উল্লেখিত বিষয় নিয়ে কালাদরাপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার উল্যা বলেন, ‘এ এলাকায় শতকরা ৮০ জন লোকই মূলতঃ চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত। এটি এখানে একদিকে যেমন এলাকার ঐতিহ্য অন্যদিকে এখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের আয়ের প্রধান উৎস।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখানে বুধ ও রবিবারে সাধারণতঃ হাট বসে। তখন ছোট ছোট কিশোর কিশোরীরা মাথায় করে চাটাই নিয়ে আসে। এ দৃশ্য আমার কাছে খুব ভাল লাগে। দুঃখ হয় যখন দেখি চাটাই শিল্পীরা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়। সারা দিন কষ্ট করে বাড়ীর মহিলারা চাটাই তৈরী করে অথচ বাজারে গেলে তারা পরিশ্রম অনুযায়ী মূল্য পায়না, দালালরা (ফড়িয়া) তাদের ঠকিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক বনে যাচ্ছে। আর চাটাই শিল্পীদের ভাগ্যের পরিবর্তন তো হচ্ছেনা উপরন্তু তারা ক্রমশঃ দরিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হচ্ছে।’ ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্যমুক্ত হয়ে তারা কিভাবে উত্তরণ ঘটাতে পারে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত যেসব নারী পুরুষ জীবিকা অর্জন করছে তারা যদি নিজেদেরকে সংঘবদ্ধ করে (অনেকটা সমিতির মত) নিজেদের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী সরাসরি গ্রাহকদের হাতে পৌঁছে দিতে পারে তাহলে তারা ন্যায্য মূল্য তো পাবেই এমনকি এ শিল্পটি দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রসার লাভ করবে। যেসব জায়গায় হোগলা পাতা উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা রয়েছে সেসব জায়গায় কেউ যদি মধ্যস্থতা করে তাহলে তাদের ভাগ্যোন্নয়ন হওয়া তেমন কোন ব্যাপারই না।’



তিনি আরো বলেন, ‘এ এলাকায় যেসব এনজিও কাজ করে, তারা এদের উপরে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিতে ব্যস্ত অথচ তারা যদি এদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে তাহলে এরা হোগলা পাতা দিয়ে শুধু চাটাই নয়, আরো নতুন নতুন সামগ্রী তৈরী করে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে।’

কালাদরাপ ইউনিয়নের কমিশনার আবুল কালাম চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারী পুরুষদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘এ শিল্পের সাথে জড়িত নারীদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক, এখানে যারা চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত তাদের পেশাটা মার খাচ্ছে মূলতঃ দালালদের কারণে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ফড়িয়াদের কাছ থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে চাটাই শিল্পীদের একটি সমিতি করতে হবে।’ আরাফাত চাটাই প্রকল্পের মালিক রুহুল আমিন বলেন, ‘আমি চেষ্টা করেছি এই প্রকল্পের মাধ্যমে এখানকার চাটাই শিল্পীদের একত্রিত করে তাদের তৈরী পণ্য সামগ্রী নিজ উদ্যোগে বাজারজাত করার জন্য। কিন্তু প্রয়োজনীয় পুঁজি ও সহযোগিতার অভাবে আমি ব্যর্থ হয়েছি, এটা সফল হলে ফড়িয়াদের কাছে আর যেতে হতোনা।’

গবেষণার মূল ফোকাস :

নোয়াখালী সদর থানাধীন দণি পশ্চিম অঞ্চলের চরমটুয়া, ৭নং এওজবালিয়া, কালাদরাপ, বিনোদপুর প্রভৃতি ইউনিয়নের প্রায় ১ লক্ষ লোক চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত। যার মধ্যে চার ভাগের তিন ভাগই নারী। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক নারীরা আর্থ-সামাজিকক জীবন যাত্রায় সকল ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।

আত্মসম্মানবোধ, নিরাপত্তাহীনতা, শিক্ষাদীক্ষায়, মত প্রকাশে, চিকিৎসাক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় এমনকি বেঁচে থাকার জন্য যে খাদ্যের প্রয়োজন সেখানেও তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রযুক্তি নির্ভর পণ্য মানুষের জীবনযাত্রাকে যান্ত্রিক করে তুলছে। মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় উৎপন্ন পণ্যের দিনদিন প্রসার ঘটছে। অন্যদিকে পরিবেশ বান্ধব পণ্য ক্রমশঃ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে নারীদের হাতে বোনা চাটাই অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। অথচ বিপুলভাবে অবমূল্যায়ন হচ্ছে চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারীরা। চরম দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। তবুও উত্তরাধীকার সূত্রে এই দরিদ্র নারীরাই এই ঐতিহাসিক শিল্পের ধারক ও বাহক। তাদের এই শিল্প চর্চা হাজার বছর ধরে প্রচলিত প্রাকৃতিক বিজ্ঞান মানসিকতার পরিচয় দেয়। এই শিল্পের মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশকে নতুন করে পরিচিত করে তুলতে পারে। সেই সঙ্গে এই শিল্পের সাথে জড়িত নারীদের জীবন যাত্রার মানোন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

প্রশিক্ষণ, পূঁজি, বাজারজাতকরণ :

চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারীরা চাটাই তৈরীতে অত্যন্ত দক্ষ। এর জন্য তাঁরা কোন প্রশিক্ষণ পাননি। বংশ পরম্পরায় তারা এ কাজে দক্ষতা অর্জন করেছেন। হোগলা পাতা দিয়ে যে অন্যান্য পণ্য বানানো যায় এবং তার অনেক বাজার মূল্য আছে এ বিষয়ে তাঁরা একেবারেই অজ্ঞ। গবেষণায় দেখা গেছে সামান্য প্রশিক্ষণ পেলে এ নারীরা বিভিন্ন সৌখিন দ্রব্য তৈরীতে সম হবেন। আন্তর্জাতিক বাজারে এগুলো রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। সিলেটের পাহাড়ী জনগোষ্ঠি বিশেষ করে খাসিয়ারা এই চাটাই ব্যপক ভাবে ব্যবহার করে। তাদের মধ্যে এর ব্যপক চাহিদা রয়েছে। পান পাতা মোড়ানোর জন্য সাধারনত এগুলো ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া সীমান্তের অপর পাড়ে চাটাই প্রচুর চালান হয়। ঘরের দৈনন্দিন কাজেও খাসিয়াদের মধ্যে চাটাই খুব জনপ্রিয়। নোয়াখালীর এই চাটাই সিলেট হয়ে খাসিয়া পুঞ্জিতে সরবরাহ হয়।

উপকূলীয় অঞ্চলে যেহেতু এই গাছ আপনাতেই জন্মে সুতরাং চাষের জন্য এর একেবারেই খরচ নেই। হোগলা গাছের পাতা পোক্ত হলে মাটির উপর থেকে গোড়া বা মূল রেখে কেটে নিলে তা থেকে আপনাতেই গাছটি আবার জন্ম নেয়। খরা বা বর্ষায় এ গাছের কোন ক্ষতি হয়না। যে কোন পরিবেশে গাছটি দীর্ঘজীবী। এক শত টাকা মূল্যের একটি চাটাই বুনতে পঁচিশ থেকে ত্রিশ টাকার হোগলা পাতার প্রয়োজন পড়ে। নারীরা ঘরে বসেই দক্ষ হাতে প্রতিদিন দুই তিনটি চাটাই বুনতে পারেন। প্রতি সপ্তাহে স্থানীয় বাজারে এগুলো বিক্রি করা যায়। এ হিসাবে যে কোন নারী খুবই সামান্য পুঁজি নিয়ে এ কাজটি করতে পারেন।


কেইস্ স্টাডি - ১


জনপি বেগমের জনপ্রিয়তা

মাত্র বার বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় জনপি বেগমের। জনপিদের ছিলো অভাবি সংসার। তার উপর মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে যেন সে নিজেই বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছে। জীবন সম্মন্ধে কোনো কিছু বুঝার আগেই বাবা মা বিয়ে দিয়ে দেয় তাকে। এ অবস্থায় শিশু বয়সেই পুতুল খেলা ছেড়ে জনপি চলে যায় শশুর বাড়ির অজানা পরিবেশে। সেখানেও অভাবের সংসার। স্বামী নূরুল আমিন শিক্ষা দীক্ষ হীন বেকার যুবক। গায়ে গতরে খেটেই চলতে হয় তাদের। এ ভাবেই অভাবের ঘানি টেনে চলছিলো তারা। সংসার সম্মদ্ধে অনভিজ্ঞ জনপি। এ অভাবি সংসারের মাঝে একে একে যোগ হয় আরো সাত সাতটি সন্তানের। চোখে মুখে অন্ধকার দেখে জনপি বেগম। নোয়াখালীর সদর উপজেলার পশ্চিমে কালাদরাপ ইউনিয়নের রাহামুড়ি তালু গ্রামে জনপির জরাজীর্ণ কুটির। অভাবের সে সংসার যেন আর চলতে চায়না। অন্ধকার যখন সব কিছু গ্রাস করে নিচ্ছিলো তখন এক কঠিন বাস্তবতার মধ্যে নিজেকে দাঁড় করায় জনপি। এলাকার নারীরা সবদিক দিয়ে পিছিয়ে। এদের উপর রয়েছে সমাজের এক অঘোষিত বিধিনিষেধ। জনপি সে বিধিনিষেধকে অগ্রাহ্য করে নেমে পড়ে নিজ ভাগ্য গড়ার ব্রত নিয়ে।
নোয়াখালীর উপকুলীয় এ অঞ্চলে প্রচুর হোগলা পাতা জন্মে। এখানকার অনেক নারী এই হোগলা পাতা দিয়ে চাটাই বানিয়ে কিছুটা আয় করতে চেষ্টা করে। এলাকার ঐতিহ্য অনুযায়ী জনপি বেগম ছোটকাল থেকেই হোগলা পাতার চাটাই বানিয়ে আসছিলো। জনপি দেখলো দিনরাত কষ্ট করে নারীরা হোগলা পাতার চাটাই বানায়। তারা এতো পরিশ্রম করেও সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। এখানে তৈরী করা হোগলা পাতার চাটাইয়ের সারা দেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে । এই এলাকা থেকে প্রচুর চাটাই দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হয়। এখান থেকে সবচেয়ে বেশী যায় সিলেট অঞ্চলে। এই চাটাই এর বাজারটি নিয়ন্ত্রনে রেখেছে এক দল ফড়িয়া আর দালাল চক্র। তারা প্রতিটি বাজার থেকে কম মূল্যে চাটাই কিনে অধিক মুনাফায় এগুলো বিক্রি করে। জনপি দেখলো ফড়িয়াদের পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন বাজারে এগুলো বিক্রি করলে সে আরো বেশী লাভবান হতে পারবে। শুরু হলো জনপির পরিশ্রমের পালা। এ এলাকায় যে সব নারীরা চাটাই বানায়, তারা সাধারনতঃ সংসারের নানান কাজের পরে প্রতিদিন দু একটি করে চাটাই বানিয়ে সাপ্তাহিক হাটে বিক্রি করে। এতে সংসারের টুকটাক খরচ চলে।
গ্রামের নিচু জমিতে সাধারন ভাবে উৎপন্ন হোগলা পাতার উপর অনেকেই জীবিকা নির্ভর করে। হোগলা পাতা সংগ্রহ করতে বা কিনতে যে টাকার প্রয়োজন পড়ে জনপি সে সামান্য টাকাও জোগাড় করতে পারেনা। তাই বলে গ্রামের অসহায় অবলা নারী হয়ে হা- হুতাস করে ঘরে বসেও থাকেনি। প্রথমে পাশের জমির মালিক থেকে বেশী দাম দিয়ে বাকীতে পাতা কিনে চাটাই বনানো শুরু করেন। বুনতে বুনতে সে এ কাজে প্রচুর দক্ষ হয়ে উঠেন। দিনরাত পরিশ্রম করে সে প্রতিদিন সর্বোচ্চ সাত আটটি চাটাই তৈরী করতে লাগলো। এতে প্রতি হাটে পঁচিশ থেকে ত্রিশটি চাটাই বিক্রি করতে থাকে। প্রতিটি চাটাই থেকে সে লাভ করে বিশ থেকে পঁচিশ টাকা। এভাবে প্রতি হাটে সে আয় করে সাত শ’ থেকে আট শ’ টাকা। তার বাড়ীর কাছে রয়েছে খলিফার হাট। প্রতি সপ্তাহে এখানে দু’বার হাট বসে। এ বাজার থেকেই প্রতি মাসে আয় হয় চার পাঁচ হাজার টাকা। অভাব যেন আস্তে আস্তে পালাতে থাকে তার ঘর থেকে। এ অবস্থায় তার নিজের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যায়। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় সে এ কাজে অরো বেশী মনোযোগ দিতে থাকে। তার এ কাজ দেখে আসে পাশের মানুষ আরো আগ্রহী হয়ে উঠে । এ কাজ সে শুধু একাই করছেনা আশে পাশের অন্যদেরকেও সম্পৃক্ত করে নিচ্ছে। শুধু চাটাই’র মধ্যে জনপি তার কাজ সীমাবদ্ধ রাখেনি। নানা রকম টুকরি ঝুড়ি ইত্যাদি সে নিজের উদ্ভাবনী মেধা দিয়ে তৈরি করে নিয়েছে। যেগুলো মানুষের সংসারের বিভিন্ন কাজে প্রয়োজন পড়ে। মানুষের কাছেও এগুলোর বেশ চাহিদা রয়েছে। তার এ কাজে স্বামী নুরুল আমিন আস্তে আস্তে সহযোগীতা করতে লাগলো। এক সময় নুরুল আমিন পুরোপুরি ভাবে এ কাজে জড়িয়ে পড়ে। দুজনে এক সঙ্গে কাজ করাতে কাজের গতিও বেড়ে গেলো। আয়ও হতে লাগলো আগের চেয়ে বেশী। ১৯৯৩ সালের দিকে তাঁরা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে পুরো পুরি চাটাই ব্যবসা শুরু করেন। নিজেদের বানানো এবং স্থানীয় বাজার থেকে কেনা চাটাই নিয়ে প্রথমে সিলেটে নিয়ে বিক্রি করেন। এতে প্রচুর লাভ হয়। তবে তারা বলে, এ কাজে লাভ লোকসানও আছে। কারন সময় বুঝে পাতার দাম উঠানামা করে। তখন সাবধানে বেচা বিক্রি করতে হয়। বাজার না বুঝলে লোকশানও গুনতে হয়। জনপি বেগম বলেন,‘আল্লার তান দাড়ি হাতা মাডে হড়ি রইছে, এ গুন দি আঙ্গো রিজিক চলে। এ হাতা দি বেরেন খাটাইলে আঙ্গো অভাব থায়নি ? অর্থাৎ ‘খোদা তালার দান মাঠে পড়ে আছে, এ গুলো দিয়েই আমাদের রিজিক চলে, আমরা যদি মাথা খাটিয়ে এর সদ্ব্যবহার করতে পারি , তাহলে আমাদের কি আর অভাব থাকে’ ? জনপি বেগম বলেন, এ এলাকার প্রায় আশি হাজার মানুষ চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে। এলাকার প্রতিটি বাড়ির প্রতিটি নারী চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত। শিশু কাল থেকেই নারীরা চাটাই তৈরিতে হাতেখড়ি নেয়।
জনপি বেগমের বড় দুই ছেলে এল্যুমিনিয়ামের হাড়ি পাতিলের ব্যবসা করে। জনপি বেগমই তাদের ব্যবসা ধরিয়ে দিয়েছে। এলাকায় জনপি এখন খুব জনপ্রিয়। বুদ্ধি পরামর্শের জন্য সবাই তার কাছে ছুটে আসে। জনপি বেগমকে এখন এলাকার সবাই ডাকে ‘জনপ্রিয়’ বেগম । সবারমুখে এ নাম তিনিও খুব খুশি।

কেইস্ স্টাডি - ২

* জাকেরা বেগমের আশা ভঙ্গের গল্প
একটি সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখতো জাকেরা বেগম (২৫)। ভালো উপার্জন করবে তার স্বামী। সংসারকে নিজ হাতে গড়ে তুলবে সে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর সৃষ্টিকর্তা তার বিপরিত ভাগ্য নির্ধারণ করে রাখে। একদিন হঠাৎ করেই বিয়ে হয়ে যায় জাকেরার। বিয়ের পর কিছু দিন বাপের বাড়িতে ছিলো জাকেরা। কয়দিন যেতে না যেতেই স্বামীর বাড়ি গিয়ে জাকেরা জানতে পারে, স্বামী নূরুল আমিন এর আগে আর এক বিয়ে করেছে। শুধু তাই নয়, সেই ঘরে তিন তিনটি সন্তানও রয়েছ। কিন্তু এ বিষয়টি জাকেরার অভিভাবকরা কেউ জানতোনা। রাগে দুঃখে অপমানে জাকেরা নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিলো। তার সুন্দর সংসারের স্বপ্ন নিমেষে খান খান করে ভেঙ্গে পড়লো। আর দেরি নাকরে জাকেরা ফিরে আসে বাবার বাড়িতে। নতুন করে স্বপ্ন দেখারও সাহস করেনি আর। অনুন্যপায় হয়ে নিজের বিয়ের ভাগ্যকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। সিদ্ধান্ত নেয় বাবার বাড়ি থেকে আর ফিরে যাবে না সে। এর পর স্বামীর বাড়িতে আর পা বাড়ায়নি। বাবার বড়িতে থেকেও কি করবে কিছুই বুঝতে পারেনা। কিছুদিন পর স্বামী তাকে নিতে আসে। কিন্ত জাকেরা তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। মনে প্রাণে দেহে যখন ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হলো তখন চাটাই পাতার মধ্যে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে জাকেরা। ছোট কাল থেকে হাতে খড়ি নেয়া চাটাই বুনোনের কাজে আবার নেমে পড়লো সে। মাঝে মাঝে স্বামী এসে দেখা করে যায়। বাবার বাড়িতে বসে স্বামীর কাছ থেকে নিজের খরচের টাকা নিতে অপমান বোধ করলো সে। ইতিমধ্যে তিন তিনটি সন্তান আসে তার কোলে। এদের সবার ভরন পোষন খরচাদি সে নিজেই বহন করে। এক মাত্র চাটাই বানিয়েই সে এগুলো উপার্জন করছে। এর জন্য তাকে দিন রাত করতে হচ্ছে কঠোর পরিশ্রম। জাকেরা জানায় প্রতি হাটে ফড়িয়ারা তার কাছ থেকে চাটাই কিনে নিয়ে যায়। সরাসরি বিক্রি করতে পারলে তার অরো লাভ থাকতো। এতো পশ্রিম করেও জাকেরা খুব সন্তুষ্ট । কারন সে মনে করে সামান্য করে হলেও চাটাই বানিয়ে সে আজ একজন আত্ম নির্ভরশীল নারী। অন্যের দ্বারস্থ না হয়ে নিজ সম্মান নিয়ে সমাজে মাথা তুলে চলছে। তার আগামী স্বপ্ন তিনটি সন্তানকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করে গড়ে তুলবে।

কেইস্ স্টাডি - ৩

• হাজেরা খাতুনের দিন কাল

একটুও সময় নেই হাজেরা খাতুনের। ৬০ বছর বয়সেও মুক্তি নেই তার। বৃদ্ধ বয়সে এসে তার জীবনটা অষ্টপৃষ্টে মিশে গেল হোগলা পাতার সাথে। কাজের সময় কারো সাথে মাথা তুলে কথা বলতে চায়না বিবি হাজেরা । কথা বললে তার সময় নষ্ট হবে। চাটাই বুনতে ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। হাজরা তিন সন্তানের জননী। স্বামী মৃত আবদুল লতিফ চাটাই ব্যবসায়ী ছিলেন। চার বছর আগে এক অসুখে মারা যান। স্বামী মারা যাওয়ার পর সংসারে এক মহা দুর্যোগ নেমে আসে। এ দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য বৃদ্ধ বয়সে চাটাই বুননের কাজ শুরু করতে হয় তাঁকে। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হাজেরা খাতুন জনান, যত দিন বেঁচে থাকি ততদিন আমাকে কষ্ট করে যেতে হবে। সংসারে স্বামী না থাকলে নারীদের জীবন আঁধার’। বড় ছেলে বিয়ে করে বৌ-নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। আর এক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিজের কাছে রাখলেন। এখন মা আর মেয়ে মিলে চাটাই তৈরি করেন। হাজেরা সপ্তাহে দুই দিন চাটাই নিয়ে খলিফার হাট বাজারে যান। চাটাই বিক্রি করে আবার পাতার আঁটি কিনে আনেন। তিন দিনে হাজেরার ৫০ টাকার মত লাভ হয়। তিন দিনে এ টাকায় কিছুই হয়না। অবশ্য মেয়ের জামাই মাঝে মাঝে সাহায্য করে। চৈত্র বৈশাখ মাসে হাজেরার বেশি কষ্ট হয়। ঐ সময় আবহাওয়ার জন্য চাটাই কম তৈরি করতে পারে। সে সময় তাঁর আয় কম হয় তাই না খেয়ে থাকতে হয় দিনের পর দিন। কয়েক দিন আগে মেম্বারের কাছে গিয়েছিলেন ভি,জি,এফ কার্ড করার জন্য। কিন্তু মেম্বার তাকে কার্ড করতে দেন নি , তার ছেলে আছে বলে। এ দিকে বিধবা ভাতা বয়স্ক ভাতা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে হাজেরা খাতুন।

কেইস্ স্টাডি - ৪

নূর নেছার হারিয়ে যাওয়া শৈশব

চাটাই শিল্পী নুর নেছা (২০)। মুখের দিকে তাকালে মনে হয় যেন জীবনের সব চেয়ে বড় কিছু হারিয়ে ফেলেছে। হাজার প্রতিকুলতার মাঝেও নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে এক কঠিন বাস্তবতায় । বিয়ের পর থেকেই চাটাই বুননের কাজে লেগে যায়। চাটাই বুনে আর মনের দুঃখে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়। নূর নেছা বলে,‘ আমার মা আমাকে বিয়ে দেয় ইট ভাটায় কাজ করে এমন এক ছেলের সাথে। যখন বিয়ে হয় তখন বয়স ছিলো ১১ বছর’। বিয়ের মর্ম সে সময় সে কিছুই জানতোনা। শশুরালয় গিয়ে দেখে বৃদ্ধ শশুর আর শাশুড়ীর সাথে এক ননদিনী আছে। সে জানত না এদেরকে কি করতে হবে কিংবা স্বামী সহ সকলকে সেবা দিতে হবে কি ভাবে। এ সময় শাশুড়ী তাকে জানায় কাজ না শিখে বাবার বাড়ী থেকে আর আসবে না। তখন নুর নেছা বাবার বাড়ীতে এসে আর শশুরালয় যায়নি। নুর নেছার মা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে মনে হয় শাস্তি পেলেন। কারণ তার বাবা নেই মা বৃদ্ধ মানুষ। কখন কোন মূহুর্তে মারা যায়, সব সময় সে ভয় তার মধ্যে কাজ করে। নূর নেছার স্বামী তাকে অনেক মার ধর করত কারণ সে এলো মেলো চলত। তখনও সে ছিল অন্য শিশুদের খেলার সাথি কি করে সে স্বামীর সংসার করবে সে জ্ঞান টুকু তার ছিলোনা। পায়ে পায়ে তার বয়স বাড়তে থাকে। একদিন সে বুঝতে পারলো সে মা হতে চলছে। কোল জুড়ে তার সন্তান এলো।একে একে এদের লালন পালন করতে হবে তাকে অতি কষ্টে জানান, ‘যদি এত অল্প বয়সে বিয়ে না হত তাহলে স্বামীর সংসারে গিয়ে আরো ভালো থাকতাম। এখন জীবনকে মিশিয়ে দিলাম চাটাইয়ের সাথে’।



কেইস্ স্টাডি - ৫

• কিশোরী নূর নাহারের দুঃখ

কিশোরী নুর নাহার (১৩) আপন মনে চাটাই বানিয়ে যায়। নোয়াখালী সদরের রাহাতালু গ্রামের বাবা মা হারা এক অসহায় কিশোরী মেয়ে। জন্মের পর পরই তার বাবা মা ইহ লোক ত্যাগ করেন। মা শফিয়া খতুনের কথা মনে হলে পৃথিবীর সব কিছু বিষাদ মনে হয়। মাও ছিলো তার চরম দুঃখিনী। মা বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইয়ের সংসারে স্থান হয়। ভাইও থাকে ভাইয়ের শশুর বাড়ীতে কিন্তু সেখানে সে ভাইয়ের বোঝা হয়ে থাকেনি। পড়া লেখা করার খুব সখ ছিলো তার। বাড়ির আসে পাশের মেয়েরা যখন দল বেঁধে স্কুলে যায়,তখন তার ইচ্ছা হয় ওদের সঙ্গে দল বেঁধে স্কুলে যেতে। কিন্তু তার অগেই তাকে ঢুকতে হয়েছে জীবনের আরো কঠিন বাস্তবতায়। নূর নাহার জানায় প্রতিদিন তিনটির মত চাটাই সে বানাতে পারে। এজন্য তাকে সকাল সন্ধ্যা কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। প্রতি হাটে চাটাই বিক্রি করে সে এক দেড়শ’ টাকা পায় এতে তার নিজের খরচ কোনো রকমে চলে যায়। নূরনাহার বলে, ‘আল্লাহ আমাকে অসহায় বানিয়ে এ দুনিয়াতে ছেড়ে দিয়েছেন। এখন মা বাবা কে নিয়ে ভাবার কোন সুযোগ নেই। অবুঝ থাকতে মা বাবা মারা যায়। তাদের চেহারা কেমন তারা কেমন ছিল। কে আমাকে ছোট থেকে বড় করল। কে আমাকে আদর যত্ম দিয়ে বড় করল এ প্রশ্ন সব সময় মনের মধ্যে তাড়না করে । আর তখনই অসুস্থ্য হয়ে পড়ি। তখন কেউ বুঝাতে চাইলেও বুঝতে পারিনা, কষ্টে বুক ভেঙ্গে যেতে চায়, যখন মনে হয়,এই পৃথিবীতে মা বাবাকে কোনোদিন আর দেখব না’।
নূর নাহার বলেন,‘বড় ভাইয়ের শশুর বাড়ীতে থাকি চাটাই বানাই। প্রতি হাটে চাটাই বিক্রি করে নিজের জীবন জীবিকা নির্বাহ করি। আমি প্রতি দিন তিনটা পর্যন্ত চাটাই বানাতে পারি। প্রতিহাটে আমার ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা লাভ হয়। আমি আমার নিজ খাওয়া পরার কাপড় যোগাড় করতে হয়। ভাইয়ের শশুর বাড়ীর লোকেরা যেন আমাকে কিছু বলতে না পারে, সেটা আমি খুব খেয়াল রাখি’।
নূর নাহার আপে করে বলে, ‘পড়া শুনা করি নাই। তবে স্কুলে যাওয়ার শখ ছিল। আপনাদের মত কাগজ আর কলম নিয়ে লিখতে আমার খুব শখ হয়। যদি লিখতে পারতাম তাহলে নিজের জীবনী লিখে সবাইকে পড়ে শুনাতাম। এই পৃথিবীটা আমার কাছে অন্ধ মনে হয়। কারণ আমার একটাই কষ্ট, আমার বাবা মা আজ কোথায়। আমি সবার কাছে দোয়া চাই আল্লাহ্ যেন আমার জীবনটা মান সম্মান নিয়ে কাটিয়ে দেয়’।


কেইস্ স্টাডি-৬

• খতিজা বেগমের আপে

খতিজা বেগমের (৩০) যখন বিয়ে হয় তখন সে হোগলা পাতার কাজ জানতোনা। হোগলা পাতা দিয়ে যে চাটাই বানায় এ বিষয়টিও সে আগে জানতোনা। নোয়াখালীর এওজবালিয়ায় যে নারীই বৌ হয়ে আসেনা কেন তাকে চাটাই বানাতে হয়। এটি এ এলাকার রেওয়াজ। আগে ভাগে কেউ যদি না শিখে থাকে তাহলে তাকে এখানের কারো কাছ থেকে চাটাই বুনন শিখে নিতে হয়। খতিজা যখন নতুন বৌ হয়ে রিক্সায় করে হেগলা বনের ভিতর দিয়ে আসছিলো, তখন রিক্সাওয়ালা রিক্সা টানতে টানতে মজা করে বলছিলো, হোগলা পাতা নতুন বৌকে শশুর বাড়ি যেতে দিচ্ছেনা। হোগলা পাতার বনের মধ্যদিয়ে যেত যেতে খতিজা ভাবছিলো, এলাকার নারীদের মত যদি সে হোগলা পাতার চাটাই বানাতে পারতো তবে সে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করতো। খতিজা বেগম বলে ‘ইয়ানে য্যাতেই আইব হেতারেই চাডাই বানাইত অইব। আগে না শিখা থাইকলে অন এতাগোত্তুন শিখতো অইব’। শশুর বাড়িতে এসে দেখে এখানে সব নারীরাই চাটাই বুননে পারদর্শী।
এখন চাটাই বানিয়ে খতিজা খুব সন্তুষ্ট নয়। কারণ সে যদি অন্যদের মত প্রতিদিন ৩/৪ টি চাটাই বানাতে পারতো তাহলে তার খুব আনন্দ হোত। খতিজা সারা দিনে একটাও বুনতে পারেনা। কারন চাটাই বুননে সে তত পারদর্শী নয়। খতিজার বর্তমানে ৩ ছেলে ২ মেয়ে। সে জানায়,‘ তারা আমার থেকে অনেক বেশি ভালো চাটাই বানাতে পারে। তারা ভাই বোন মিলে দিনে ৫/৬ টি চাটাই বানাতে পারে’ । খদিজার স্বামী চায়ের দোকানে কাজ করে। তার সাথে সাথে চাটাই বুনতে খতিজাকে সাহায্য করে। চাটাই বুনা হয়ে গেলে স্বামী বাজারে বিক্রি করে। কখনো কখনো তার বড় মেয়ে রিংকু (১০) বাজারে গিয়ে চাটাই বিক্রি করে আসে। রিংকু প্রাইমারি স্কুলে ৫ম শ্রেণীতে পড়ে। সে চাটাই বুনতে এখন খেকেই অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। চাটাই বানাতে সে মা ও বড়দের সাহায্য করে।


কেইস্ স্টাডি - ৭

• আনোয়ারার সুখের সংসার

নোয়াখালী কালাদরাপ ইউনিয়নের রাহামুড়িতালু গ্রামের আনোয়ারার বিয়ে হয়েছিলো মাত্র তের বছর বয়সে। এ গ্রামেই তারজন্ম। ছোট্ট কাল থেকে সে দেখে আসছে গ্রামের প্রায় সব নারীই চাটাই বানাতে পারে। গ্রামের অনেকেই দল বেঁধে এক সাথে বসে চাটাই এর কাজ করে। এ দৃশ্য দেখে তার খুব ভালো লাগতো। ছোট বয়সেই সে চাটাইয়ের কাজ শিখে নিয়েছে। এ কাজে তাকে বড়রা খুব সহযোগীতা করেছিলো। বিয়ের পাঁচ বছর পরে তারকোল জুড়ে আসে তাদের প্রথম সন্তান। আনোয়ারার স্বামী ছোট একটা চায়ের দোকান করে। সারাদিনের ঘর কন্যার কাজ করে আনু বসে যায় চাটাইয়ের কাজনিয়ে। সারা দিনে সে যে চাটাই বানায় সেগুলো প্রতি হাটে তার স্বামী বিক্রি করে। বিক্রির টাকা তারা অন্য কোনো কাজে খরচ না করে নিজেদের কাছে জমা রাখছে। তাদের ইচ্ছা সে টাকা দিয়ে তারা নতুন টিনের ঘর তৈরী করবে। সে আশায় আশায় তারা দিন গুনছে। আরো স্বপ্ন দেখে কবে তাদের মেয়ে বড় হবে। চাটাই বানানোর টাকা দিয়ে মেয়েকে অনেক দুর পর্যন্ত পড়ানোর ইচ্ছা আছে তাদের। আনু জানায়, ‘স্বামী স্ত্রী মিলে এক সাথে কাজ করলে সংসারে কোনো অভাব থকেনা। দুজনে সমঝোতার মাধ্যমে চলতে পারলে সংসারে উন্নতি লাভ করা যায়’। আনু বলে ,‘গেরামের হোগলা পাতা আঙ্গোরে বাঁচাই রাখছে’। চাটাইয়ের কাজ করতে পেরে সে খুব খুশী। আনু জানায় ,‘আমি এখন খুব সুখী। আমার মনে হয় আমার মত আর কেউ এতে সুখী নয়’।


কেইস্ স্টাডি - ৮

চাটাই বুনে শশুরের ঋণ শোধ করলেন মারজাহান

কষ্টকে মোকাবিলা করতে হলে সংগ্রাম করতে হবে। সে নারী হোক, আর পুরুষ হোক। কথাটা বললেন মারজাহান (২৫)। মারজাহান ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া লেখা করেছেন। মারজাহান বিয়ের আগে কোন দিন চাটাই তৈরি করে নি। বিয়ের পরে স্বামীর সংসারে এসে দেখতে পায় চাটাই বানানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। অন্য সকলের জন্য সেও চাটাই বানানোর কাজ হাতে নিল। প্রথমে তার খুব কষ্ট হয় । মারজাহান আরো জানায়, তার শ্বশুরের মৃত্যুর আগে অনেক টাকা ঋণ করে গেছেন। তাদেরকে এ ঋণের বোঝা বইতে হয়েছে। ১৮ হাজার টাকা ঋণ শোধ করতে হবে। এ অবস্থায় মারজাহান গ্রামীণ ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেয় ১০ হাজার টাকা। শর্ত ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের টাকা এক বৎসরে শোধ করতে হবে। মারজাহান চাটাই বানিয়ে প্রতিহাটে তা বিক্রি করতো । এ টাকা জমা করে প্রতি সাপ্তাহে কিস্তিতে শোধ করতো। এভাবে প্রথম বছর ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শ্বশুরের ঋণের টাকা শোধ করলেন। তিনি জানান গ্রামীণ ব্যাংক আমাকে সহযোগিতা করেছে আবার চাটাই তৈরিতেও সহোযোগিতা করেছে। একদিকে সুখী আবার অন্য দিকে অসুখী।
অসুখী কেন জানতে চাইলে বলে, ‘এই যে সারাদিন চাটাই তৈরি করি সাথে অন্য সব কাজ করে থাকি। কোমর ব্যাথা সব সময় লেগে থাকে। ভালো ডাক্তার দেখানোর কোন সুযোগ নেই। ডাক্তারের যে খরচ সে খরচ বহন করার মত স্বামীর আয় নেই। তাই ভালো ডাক্তার দেখাতে পারি না’।
স্বামী বাহার উদ্দিন জানায় আমাদের পড়া লেখা নেই তাই আমরা কোন দিন বড় হতে পারবো না। আমরা এমনই থাকতে হবে। যদি পারি আমাদের
সন্তানদেরকে নিয়ে চেষ্টা করব পড়া শুনা করাবার জন্য।

কেইস্ স্টাডি - ৯

নূরজাহানের দুঃখ জয়ের গল্প

সময় মানুষকে বদলাতে পারে। কিন্তু তার জন্য নীরবে যুদ্ধ করতে হয়। আর এ যুদ্ধ মানুষকে বড় করে। আবার কখনো পতন ঘটায়। তেমনি এক নারী নুরজাহান (৩৫)। জীবন ভর যুদ্ধ করে যাচ্ছে নিজেরই জীবনের সাথে । এক সময় চাটাই বানিয়ে কোন রকমে ৯ সদস্যের পরিবারের ভরন পোষন চলত। এতে যে টাকা পাওয়া যেতো , তাতে নিদেনপে আধমুঠো খাওয়ার জুটতো কখনো কখনো । পেট ভরে খাওয়ার সুযোগ হয় নি কোনোদিন। একদিন স্বামী আবছার তাকে ডেকে বলে ‘চলো আমরা চিটাগাং চলে যাই, ওখানে আমরা দু’জনে কাজ করবো। সাথে আমাদের বড় ছেলেও থাকবে। আমরা ভালো আয় করতে পারব’। নোয়াখালীর সদরের কালাদরাপ ইউনিয়নের এওজবালিয়া গ্রামের সহজ সরল কুল বঁধূ নুরজাহান স্বামীর সঙ্গে পুরো পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম চালে যায় । সেখানে অজানা অপরিচিত পরিবেশ। প্রথম প্রথম খুব কষ্টের মধ্যে পড়ে তারা। কখনো কখনো প্রতিদিনের খাওয়ারও যোগাড় হতোনা। নুরজাহান নোয়াখালী থেকে যাওয়ার এক বছর পর চট্টগ্রাম নাছিরাবাদ এলাকায় ইট ভাঙ্গার কাজ নেয়। বড় ছেলে রাজ জুগালীর কাজ শুরু করে। এভাবে কোনদিন একশ’ আবার কোন দিন পঁচাত্তর আশি টাকা আয় করতে থাকে। শরীর ভালো থাকলে দুইশ’ টাকাও রোজগার হয়। এ টাকায় প্রতিদিনের খরচ মোটামুটি চলে যায় তাদের।
নূরজাহান বলে, আমি যদি এই চাটাইয়ের উপর নির্ভর থাকতাম তাহলে প্রতিদিনের খাওয়ার নিশ্চিত করতে পারতাম না। তার কষ্টের কথাগুলো বলতে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেলে। সংসারের একটু স্বছলতা দেখে স্বামী আবছার তাঁকে রেখে আবার বিয়ে করে ফেলে । এতে নুরজাহান বাধা দিলে সংসারে নেমে আসে অশান্তি। নুরজাহন চিন্তা করেন যদি স্বামীকে বাদ দিয়ে দেই তাহলে লোকে আমাকে খারাপ বলবে, কিন্তু আমার সংসারে শান্তি হবে। তার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী তাকে খুব অত্যাচার করতে থাকে। সতীন তাঁর ভাইদের কে দিয়ে নূরজাহানকে মারধর করে। নূরজাহান সব কিছুকে ঠান্ডা মাথায় মোকাবিলা করে। নূরজাহান সে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরকে বলে কয়ে স্বামীকে আবার সংসারে ফিরিয়ে আনেন। অবস্থার বেগতিক দেখে নূরজাহানের সতীন তাদের ছেড়ে চলে যায়। তার স্বামী অনুতপ্ত হয়ে তার কাছে হাত জোড় করে মা চায় । সে যে ভুল করেছে তা সে বুঝতে পারে। নুরজাহান বলেন, ‘এতেই আমি খুশী’। ভাঙনের মুখোমুখী হয়েও তিনি বিচলিত হননি। অসীম ধৈর্য্য ধারন করে নূর জাহান তার গড়া সংসারকে শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হোলেন। নূরজাহান বলেন,‘আল্লার দুইন্নাইত ম্যাইনসের সংসারের মাইদ্দে ব্যাস-কম ঝামিলাতো আছে, এগুলার লগে যুদ্ধ করি টিকতো না পাইরলে কপালে দুঃখ লই থাইকতে হয়’। অর্থাৎ নূরজহান বলছেন, আল্লার দুনিয়াতে মানুষের সংসারের মাঝে কম বেশী ঝামেলাতো আছে, এর সাথে যুদ্ধ করে টিকতে না পারলে কপালে দুঃখ নিয়ে থাকতে হয়।

কেইস্ স্টাডি - ১০

চাটাই ব্যবসা করে আত্ম নির্ভরশীল

বাপ দাদার আমল থেকে শুরু হল এ কাজ। তাই আমরা আর অন্য কাজে যাই কি ভাবে, হোরন বলে, ‘ছোট্ট বেলা থেকে আমি চাটাই তৈরি করতাম আমার মায়ের সাথে। আমরা দুই ভাই এক বোন। আমি সবার বড়। আমার বয়স যখন ১৮ বছর তখন আমার বাবা মারা যায়। বাবা মৃত্যুর সময় রেখে গেছে একটা ভিটা । তিন ভাই বোন আর মাকে নিয়ে আমাদের সংসার। হোরণ বলে, ‘বাবার চাটাই ব্যবসার হাল ধরতে হল আমাকে। চাটাই বানানো, সংসারের দায়িত্ব , ঋণের বোঝা, সবকিছু ছিল আমার মাথার উপর। সব সময় চিন্তা থাকতো কিভাবে এ সব মোকাবিলা করা যায়।
বাবার মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরে আমি নিজে সাহস করে হাটে গিয়ে ৭ হাজার টাকার চাটাই কিনে আনি। এ চাটাই গুলো নিয়ে যাই সিলেটে, তখন থেকে আমার সাহস বেড়ে যায় এবং ব্যবসার সম্পর্কে মোটামুটি বুঝতে পারি। প্রথম ৭ হাজার টাকায় লাভ হয ২ হাজার টাকা। প্রথম বারই সিলেট থেকে আসার সময় মাস্তানরা আমাকে ধরে সব টাকা নিয়ে যায়। বাড়ীতে এসে যখন মাকে জানালাম মা আমাকে সান্তনা দিয়ে বলেন, ‘আমরা গ্রামীণ ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণনিয়ে আবার ব্যবসা করব’। ঋণ নেয়া হলো ১০,০০০/- টাকা , ৫ হাজার টাকা চাটাই কিনে আর বাকী টাকা থেকে বাবার কিছু ঋণ শোধ করেছি। কিছু টাকা দিয়ে হোগলা পাতা কিনা হলো ঘরে চাটাই তৈরি করার জন্য। মা এবং আমার বোন সে পাতা দিয়ে চাটাই তৈরী করলো। একটি চালান নিয়ে আবারও আমি সিলেটে নিয়ে যাই। এবার আমার টাকায় টাকা লাভ হয় । বাড়ী এসে সব কটি টাকা মাকে দিয়েছি। মা আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বলে তোদের বাবা নেই তাতে কি হয়েছে আমার ছেলেতো আছে। আমার মায়ের দোয়ায় আজ আমি অনেক ভালো আছি। আমি আর কোন দিন এক বেলা না খেয়ে ছিলাম না। জীবন আর জীবিকার তাগিদে সংগ্রাম করেছি। আজ নির্দিষ্ট একটা অবস্থানে আছি। কারো মুখাপেক্ষী হতে হয় না। বৌ বাচ্চা আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে আল্লাহ আমাকে অনেক ভালো রেখেছেন। আমার মত এ রকম যারা আছে আমি তাদেরকে উৎসাহ দিয়ে থাকি। শ্রম দিলে শ্রমের মূল্য পাওয়া যায়। এটা কোন কঠিন বিষয় নয়। যেহেতু আমরা অশিতি। আমাদেরকে শ্রম দিয়ে জীবন বাঁচাতে হবে’।
যদি হোরনের মত অন্য শ্রমজীবী মানুষ সময়ের মূল্য দিয়ে থাকে তাহলে মনে হয় আর কারো দারিদ্রের শিকার হতে হবেনা।



এক নজরে গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল

 উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী একটি কৃষি প্রধান অঞ্চল। এই জেলার প্রায় এক লক্ষ মানুষ চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে যার আধিকাংশই নারী। শিল্প কারখানার দিক দিয়ে নোয়াখালী একটি পশ্চাদপদ জেলা। শিক্ষাদীক্ষায়ও গ্রামীণ নারীরা অনেক পিছিয়ে। দৈনন্দিন ঘর কন্যার কাজ ছাড়া এদের করণীয় কিছুই থাকেনা। তবে সারাদিনের কাজের ফাঁকে ফাঁকে এরা নিত্যপ্রযোজনীয় নানান জিনিষ তৈরী করে থাকে। চাটাই তার মধ্যে অন্যতম। সম্পূর্ন হাতে তৈরী এ পন্যটি ধীরে ধীরে গ্রামীণ শিল্প হিসাবে প্রসার লাভ করেছে। গ্রামীণ নারীরাই এর প্রধান কারিগর।
 গ্রামীণ শিল্প হিসাবে এর প্রসার ঘটলেও এর জন্য কোনো পরিকল্পিত বাজারব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। যুগযুগ ধরে এ শিল্পের সাথে জড়িত থেকেও নারীরা তাদের আর্থিক অবস্থা পরিবর্তন করতে পারেনি।
 আর্থিক অস্বচ্ছলতা,সামাজিক দৈন্যতা,নারীদের প্রতি সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদির কারণে এখানে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটেনি।তাই এলাকার নারীদের শিক্ষার হারও খুব কম।
 গবেষণা এলাকায় বিভিন্ন এনজিও ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এনজিওদের ঋণ কার্যক্রম মূলত তাদের সূদ ব্যবসার প্রসার ঘটেছে।
 অনেক নারীই এই ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে আছে। নারীরা তাদের নামে ঋণ নিয়ে স্বামী শ্বশুর ভাই কিংবা ছেলের হাতে তুলে দেয়। এই ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে এর ঘানি টানতে হয় নারীদেরকেই।
 এই ঋণে এরা জর্জরিত হয়ে থাকলেও ঋণ এবং অনুদান সর্বদা এদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। যে কানো আর্থিক টানাপোড়নে এরা ঋণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
 নারীদের আয়ের পুরো অংশই স্বামী অথবা পরিবারের জন্য খরচ করা হয়। চাটাই বিক্রির টাক নারীরা স্বামীর হাতে তুলে দেয়। চাটাই বিক্রির সামান্য যে টাকাটি পায় তাও তারা নিজেরমত করে খরচ করতে পারে না।
 এলাকার মানুষদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই করুন । ৯৫%পরিবার একেবারেই নিম্ন আয়ের এখানকার পুরুষদের মূল পেশা কৃষি। ঘনবসতি পূর্ণ এই এলাকার অধিকাংশ মানুষের নিজেদের কৃষি জমি নেই। অন্যের জমিতে শ্রম বিক্রি করেই এদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়।
 এলাকার নারীরা এক সীমাবদ্ধ জীবন যাপন করে যাচ্ছে।এদের জীবন ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যে একই চক্রে আবদ্ধ হয়ে আছে। এলাকার সামাজিক কোনো কাজে নারীদের কোনো প্রকারের অংশ গ্রহন নেই।
 এই নারীরা বিশ্বাস করে, পুরুষরাই শ্রেষ্ঠ,নারীদের উপর কতৃত্ব করার অধিকার রয়েছে পুরুষদের। নারীদের সৃষ্টি হয়েছে পুরুষদের সেবাদাসী হিসাবে।
 হাজার কষ্টের মধ্যে থেকেও এরা অসম্ভব পরিশ্রমী ও কাজের প্রতি খুবই নিষ্ঠাবান।
 শহুরে জীবনের নানান সুবিধা বঞ্চিত শ্রমজীবী এ গ্রামীণ নারীরা গ্রামবংলার একটি অতি নগন্য কৃষি পন্য দিয়ে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে অবদান রাখছে অথচ এরা চিরকাল অবহেলিত অবস্থায় লোকচুর অন্তরালে রয়ে গেছে।
 যে পাতা দিয়ে চাটাই তৈরি করা হয় স্থানীয় ভাবে এটি হোগলা পাতা হিসাবে পরিচিত। হোগলা গাছ সাধারনতঃ ১২ থেকে ১৫ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। কাঁচা অবস্থায় এর রং থাকে গাড় সবুজ। শুকানো অবস্থায় এর রং হয়ে উঠে গাড় সোনালী। প্রায় এক ইঞ্চি ব্যসার্ধ্যের ত্রিকোনাকৃতির মাংসল পাতা এর প্রধান বৈশিষ্ট্য।
 অন্যান্য পন্যের চেয়ে অনেক সস্তায় সহজে পাওয়া যায় বিধায় নিম্নবিত্ত ও সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ এই চাটাই ব্যপক হারে ব্যবহার করে।
 এ পাতা দিয়ে চাটাই ছাড়াও ঘর তৈরির বেড়া, টুকরী,পাখা, ছোট বাক্স,শিকা,দড়ি,ঘর সাজাবার সৌখিন দ্রব্যাদি, উন্নতমানের হস্ত শিল্প তৈরী করা যায়।
 কোনো প্রকারের কৃত্রিম আঁশ এর সাথে মিশানো হয়না। এটি ১০০% পরিবেশ সম্মত।
 হোগলা গাছ প্রাকৃতিক ভাবে নীচু জলজ সা্যঁতস্যাঁতে মাটিতে আপনাতেই জন্ম নেয়। একবার জন্মালে এটি সহজে মরেনা। গোড়া থেকে কেটে নিলে সেখান থেকে এটি আপনাতেই আবার গজিয়ে উঠে
 এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য সরকারী বেসরকারী কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি তবে দু’ একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান হোগলা পাতা দিয়ে তৈরি উচ্চমানের হস্তশিল্প
তৈরী করে বিদেশের বাজারে রফতানী করার চেষ্টা করছে।
 চরম দারিদ্রতার মধ্যে জীবন যাপন করলেও এদের মধ্যে রয়েছে এক বিশেষ স্বাতন্ত্র বোধ। গ্রামীণ নারী হয়েও এরা মনে করে সুযোগ ও সহযোগিতা পেলে একদিন এরা অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করতে পারবে।
 কাজের প্রতি একাগ্রতা থাকায় এদের মধ্যে আছে এক অমিত সম্ভাবনা। যেকোনো কাজই এরা খুব আগ্রহ সহকারে করে থাকে।
 নোয়াখালীর কয়েকটি গ্রামীণ বাজার চাটাইয়ের জন্য বিখ্যাত। এ এলাকা থেকে মাসে কোটি টাকার চাটাই দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়
 এলাকার প্রতিটি গ্রামেই হোগলা পাতার বন রয়েছে কোনো জমিতে একবার হোগলা গাছ জন্মালে তা বহু বৎসর পর্যন্ত টিকে থাকে । মাটি থেকে শিকড় সহ মূল উৎপাটন না করলে এর বংশ বিস্তার হতে থাকে
 হোগলা পাতা দিয়ে উৎপাদিত পন্য প্রধানতঃ আভ্যন্তরিন বাজারে সরবরাহ করা হয়।
 এখান থেকে ব্যবসায়ীরা সিলেট,ঢাকা , চট্টগ্রাম, রংপুর সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে।
 স্থানীয় ফড়িয়ারাই মূলত চাটাইয়ের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। নারীদের কাছ থেকে কম দামে কিনে এরা অধিক মুনাফায় দেশের বিভিন্ন যায়গায় বিক্রি করে।








গবেষণার আলোকে সুপারিশ

হোগলা পাতার এ শিল্পটির রয়েছে এক উজ্বল সম্ভাবনা। এ থেকে পরিবেশ সম্মত পন্য উৎপাদন হয় বিধায় দেশ বিদেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সিলেটের পাহাড়ী জনগোষ্ঠির মধ্যে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। সীমান্তের অপর পাড়ে পাহাড়িদের মাধ্যমে এই চাটাই ব্যাপক হারে পাচার হয়। কুটির শিল্প হিসাবে এর প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে । তবে প্রচারের অভাবে এটি তেমন বিকাশ লাভ করেনি। অংশগ্রহণমূলক কর্মগবেষণায় যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে তা হলো এটিকে ঠিক গতানুগতিক গবেষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এর একটি সুদূর প্রসারী কর্মসুচী নেয়া প্রয়োজন। মাত্র ৬ মাসের গবেষণায় একদিকে যেমন ছিলো চাটাই শিল্পে জড়িত দরিদ্র নারীদের সামাজিক পরিবর্তনের ভাবনা, তেমনি এই সম্ভাবনাময় উপেতি গ্রামীণ শিল্পের প্রসারের ক্ষেত্রে খুঁজে পাওয়া গেছে অমিত সম্ভাবনার দ্বার। যার অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে অসীম।

এর জন্য প্রয়োজন :

 নারীদের মধ্যে কুটির শিল্প প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা । হোগলা পাতা দিয়ে শুধু চাটাই তৈরী করেই নারীরা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে হাগলা পাতা দিয়ে শুধু চাটাইই নয় নানান আকর্ষনীয় সৌখিন পন্য উৎপাদন করা যায়, দেশে বিদেশে যার অনেক বাজার মূল্য রয়েছে। এর দ্বারা গ্রামীণ নারীরা যথেষ্ট লাভবান হতে পারবেন।
 ফড়িয়াদের মাধ্যমে উৎপাদিত পন্য বিক্রি না করে নিজেরাই নিজেদের পন্য সুবিধামত বিক্রি করার ব্যবস্থা করা, এর জন্য নিজেদের পুঁজি সৃষ্টি প্রয়োজন। এই নারীদেরকে সচেতনতা মূলক প্রশিক্ষণ কিংবা আরো অংশগ্রহণমূলক কর্ম গবেষণার প্রয়োজন, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের সমস্যা নিজরা চিহ্নিত করতে পারবেন এবং নিজেরাই তা সমাধন করতে সচেষ্ট হবেন।
 চাটাই ছাড়াও ঢাকা ও বিদেশের বাজার সৃষ্টির জন্য নতুন নতুন পন্য তৈরী করার কৌশল সম্মন্ধে সার্বক্ষণিক ফলোআপ করা। পরিবেশ পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে গ্রাহকদেরও রুচির পরিবর্তন ঘটে। বাজার সৃষ্টির লক্ষে মানুষের রুচি অনুযায়ী পন্য উৎপাদন করা প্রয়োজন। এর জন্য পর্যবেক্ষণ সেল থাকা প্রয়োজন, অন্ততঃ যত দিন সম্ভব।
 নারীরা যেন নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে এমন সংগঠন তৈরী করার ত্রে সৃষ্টি করে দেয়া। যার মাধ্যমে তারা নিজেরাই আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারবেন।
 নারীদের উৎপাদিত পন্য যেন নারীরা নিজেই নিজেদের আওতায় রাখতে পারে তার জন্য নিজেদের নিয়ন্ত্রিত সেল সেন্টারের ব্যবস্থা করা।
 এলাকার শিশুদের প্রায় ক্ষেত্রে গতানুগতিক স্কুলের প্রতি রয়েছে ব্যাপক অনিহা। ৩ থেকে ৫ বৎসরের শিশুদের জন্য আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষামুলক স্কুলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পরবর্তী জীবনে যেন এরা স্বয়ংকৃয়ভাবে স্কুল মুখী ও শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে।


মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ রিইব মিলনায়তন, ঢাকা ৪ এপ্রিল ২০০৫

পুরাতন হাসপাতাল সড়ক
মাইজদী কোর্ট, নোয়াখালী
ফোন-০৩২১-৬১৪৭০
মোবাইল-০১৭১১২২৩৩৯৯
email:-mhfoez@gmail.com