স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা #### মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

পরিবেশের পরিবর্তন, নোয়াখালীর জন্য সুসংবাদ !




পরিবেশের পরিবর্তন, নোয়াখালীর জন্য সুসংবাদ !মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

গত কয় বছর ধরে বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে পরিবেশ বিপর্যয়ের নানান আশঙ্কার কথা শুনা যাচ্ছে। তাঁরা বলছেন, পৃথিবীতে নেমে আসছে মারাত্মক দুর্যোগ। উষ্ণ হয়ে উঠছে পৃথিবী, ঝড় ঝঞ্ঝা জলোচ্ছাস বেড়ে যাচ্ছে, মানুষের রোগশোক বাড়ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ খবর হলো বায়ুমন্ডল উত্তপ্ত হওয়ার কারনে সাগর ফুলে ফেঁপে উঠছে। ফলে সাগর পাড়ের দেশগুলো ডুবে যাবে। ডুবে যাবে সে দেশের মানুষ আর প্রতিবেশ। সব চেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল।
গত ২৭জুলাই ‘০৮ দৈনিক প্রথমআলোতেই পাশাপাশি দুটি ভিন্ন ধর্মী লেখা ছাপা হয়। ‘রক্তে জন্ম পানিতে মরণ’ এবং ‘না, বাংলাদেশ তলিয়ে যাবেনা’ শিরোনামে যথাক্রমে বৃটিশ সাংবাদিক জোহান হারি ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড:এম,এইচ,খান এ দু’টি প্রবন্ধ রচনা করেন। প্রথম জন আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশ আগামী শতাব্দীতে লোনা জলে ডুবে যাবে। অন্যজন শুনিয়েছেন আশার বাণী। যাঁরা উপকূলে বংশপরম্পরায় বাস করে আসছেন, এলাকার মানুষের সাথে থেকে যাঁরা নীবিড়ভাবে কাজ করেন, এখানের বৈচিত্র্যময় আবহাওয়া পরিবেশকে যেভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারেন, অনুভব করেন। হঠাৎ করে এসে কেউ তা ধরতে পারার কথা নয়। প্রকৃতির মত বড় বিজ্ঞান আর কিছু হতে পারেনা। আথচ আমরা প্রায় ক্ষেত্রে এ বিজ্ঞানকেই পাশ কাটিয়ে যাই।
শত বছর ধরে নোয়াখালীর উপকূল ভাঙ্গা গড়ার খেলায় মত্ত। প্রকৃতির এ অনবদ্য খেলায় কিছু এলাকার ভূমি ভেঙ্গে ভেঙ্গে সাগরে হারিয়ে গেছে। পঞ্চাশের দশকে হাজার বছরের সমৃদ্ধ নোয়াখালী শহর সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায় সাগর গর্ভে। তখন নোয়াখালী শহর অস্থায়ী ভাবে স্থানান্তরিত করা হয় দশ কিলোমিটার উত্তরে মাইজদীতে। সাগরের তখনো রুদ্র রুক্ষ রোষ। তখন আনেকেরই আশঙ্কা ছিলো মাইজদীও নদীতে ভেঙ্গে যাবে। বিকল্প শহর হিসাবে তখন বিবেচনায় রাখা হয়েছিলো বেগমগঞ্জ ও ফেণীকে। ফেণী তখন নোয়াখালীর সাবডিভিশান। চল্লিশের দশকে বৃটিশ আমলে নোয়াখালীকে সাগর থেকে রক্ষা করার জন্য সে সময়ের এক তরুন মাইনিং ইঞ্জিনিয়র ওবায়দুল্লা ইঞ্জিনিয়র স্থানীয় মানুষদের সম্পৃক্ত করে স্বেচ্ছাশ্রমে সাগর আর প্রচন্ড ক্ষরস্রোতা মেঘনার মোহনায় ঠিক সাগরের উপর দিয়েই অবিশ্বাস্য ভাবে একটি বাঁধ তৈরী করে ছিলেন। সফলও হয়েছিলেন। পরবর্তীতে সে বাঁধ ওবায়দুল্লা ইঞ্জিনিয়র বাঁধ হিসাবে খ্যাতি লাভ করে। এলাকায় সে তরুন এখন কিংবদন্তিতে পরিনত হয়ে আছেন। সে সময়ের শিশু কিশোর এখন বয়:বৃদ্ধ অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাবে যাঁরা আবেগআপ্লুত হয়ে সে সাগর রুখে দেয়ার বিরত্বের কাহিনী বর্ণনা করবেন। সে বাঁধ দেয়ার ফলে সাগর শান্ত হয়। থেমে যায় ভাঙ্গন। কিন্তু অন্য এক উপসর্গ দেখা দেয়। মোহনার যে অংশে বাঁধ দেয়া হয়েছিলো সেখান দিয়ে বর্ষার উজানের পানি স্বাভাবিক ভাবে আর ভাটিতে যেতে পারছিলোনা। ফলে বেগমগঞ্জ সহ ব্যাপক এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। সেখানে কোনো ফসল হচ্ছিলোনা। কৃষকরা ক্ষেপে গিয়ে দলবদ্ধ হয়ে এক সময় সে বাঁধ কেটে দেয়। বাঁধ দেয়ার ফলে ধীরেধীরে দক্ষিণে যে পলি জমতে শুরু করেছিলো তা বাধাগ্রস্ত হয়। আবার ভাঙ্গতে থাকে গড়ে উঠা চর । এক সময় ভাঙ্গন এসে থমকে যায় বর্তমান নোয়াখালী সদর মাইজদী শহর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে সোনাপুরে। সে বাঁধের অভিজ্ঞতা থেকে ষাটের দশকে নোয়াখালীতে মেঘনার মোহনায় পর পর দুটি বাঁধ নির্মত হয়। একটি হয় বর্তমান নোয়াখালী সদরের দক্ষিণে আর একটি লক্ষীপুরের রামগতিতে। যথাক্রমে যা ওয়াবদা বাঁধ এবং তোহা বাঁধ হিসাবে পরিচিত। এর ফলে সাগরে পলি জমতে শুরু করে। সৃষ্টি হয় নতুন চর। মাত্র ষাট সত্তর বছর আগে যে সাগর এসে ঠেকেছিলো সোনাপুরে নতুন চর দেয়ার ফলে সে সাগর চলে গেছে সত্তর আশি কিলোমিটার দক্ষিণে। চোখের পলকে যেন এ ভাঙ্গাগড়ার খেলা হয়ে গেলো। সাগর থেকে এখনো নতুন নতুন চর জেগে উঠছে। প্রায় নব্বই বর্গকিলোমিটারের বয়ার চরটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে সাগর থেকে জাগতে শুরু করে। সে চর নিয়ে রক্তারক্তিও কম হয়নি। নোয়াখালী চর উন্নয়ন সংস্থা সেখানে ভূমিহীনদের খাসজমি বন্দোবস্ত দিয়েছে। ভূমিহীনরা এখন সেখানে উৎপাদন করছেন নানান ফসল। সরজমিনে সাগর মোহনায় গেলে যে কেউ দেখতে পাবেন, কি অবিশ্বাস্য ভাবে দক্ষিণে ভেসে উঠছে চরগুলো। ষাটের দশকে নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপের দক্ষিণে দূর সমুদ্রে ভেসে উঠেছিলো নিঝুম দ্বীপ। বর্তমানে সে দ্বীপটি পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এক সময় তরঙ্গবিক্ষুব্ধ উর্মিমালা ভেঙ্গে যেতে হতো নিঝুম দ্বীপে। এখন সে দ্বীপে হাতিয়ার জাহাজমারা হয়ে বন্দরটিলা নামের খেয়া পেরিয়ে সহজে যাওয়া যায়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, দীর্ঘদিন সে এলাকায় যারা প্রতিনিয়ত যাতায়ত করেছেন, তাঁদের কাছে এ সব কিছু বুক ভরে যাওয়া আশা জাগানিয়া প্রকৃতির এক অনন্য চমক ছাড়া আর কিছুই নয়। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের কারনে এ তথ্যগুলো পেতে আমাদের অনেক সহজ হয়েছে। ইন্টারনেটে গুগলআর্থে সার্চ করে যে কেউ দেখতে পাবেন নোয়াখালীর উপকূলে কি বিপুল পরিমান ভূমি জেগে উঠছে। ভূমি ও পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করছে এমন একটি সংস্থা ‘সেন্টার ফর এনভারমেন্ট এন্ড জিয়োগ্রাফিক্যাল ইন্ফরমেশন্স সার্ভিসেস’ এর মতে আগামী পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের উপকূলে প্রায় একহাজার বর্গ কিলোমিটার ভূমি সাগর থেকে জেগে উঠবে। বলা বাহুল্য এগুলোর প্রায় সবটাই হবে নোয়াখালীর উপকূলে। উক্ত সংস্থার অন্যতম গবেষক ও নদী বিশেষজ্ঞ মমিনুল হক গত ৩১জুলাই বিবিসির সাথে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, হিমালয়ে উৎপন্ন নদীগুলো প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টন পলি মাটি বয়ে আনছে। এর পরিমান প্রায় এক বিলিয়ন টন। এর ফলে প্রতি বছর কুড়ি বর্গ কিলোমিটার করে ভূমি উপকূলে যোগ হচ্ছে। জলবায়ু উষ্ণতার কারনে সমুদ্রোপকূলীয় ভূমিগুলো যে ডুবে যাবার আশঙ্কা বিজ্ঞানীরা করছেন সে সাথে বাংলাদেশও যে ডুবে যাবে সে আশঙ্কা খন্ডন করে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাগরের উচ্চতা বেড়ে যাবে ঠিক কিন্তু বাংলাদেশের উপকূল ডুবে যাবার আশংকা নেই। বরং ঘটনা ঘটবে তার উল্টো। বরং সেখানে জমি গুলো আরো উঁচু হবে এবং সাগরে জাগবে নতুন নতুন চর। এর কারণ হিসাবে তিনি জানান, ’৫৭ সালে ও ’৬৩ সালে যে দুটি বাঁধ নির্মিত হয়েছে তার ফলে এখানে ভূমি গঠন দ্রুত হয়েছে এবং ’৫০সালে আসামে একটি প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প হয়েছিলো তখন সেখানে ব্যাপক ভূমিধ্বস হয়। সে ভূমি ব্রহ্মপুত্র হয়ে বাংলাদেশের সাগর মোহনায় পলিমাটি হয়ে জমা হচ্ছে। এ পলি জমা অবশ্য শত শত বছর ধরেই চলছে এবং এখনও তা অব্যাহত আছে। গত পঞ্চাশ বছর তা কিছুটা দ্রুত গতিতে হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবীর মানুষ নানান দুর্যোগের মধ্যে পড়বেন । বাংলাদেশেও এ থেকে বাদ যাবেনা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনেকটা শাপে বর হওয়ার মত। হিমালয়ের বরফ গলে লক্ষ লক্ষ টন পলি বয়ে নিয়ে আসবে বাংলাদেশের উপকূলে। হাজার বছর ধরেই এ প্রকৃয়া অবশ্য চলে আসছে। এখন তা কিছুটা দ্রুত হবে। কারণ হিমালয়ের বরফ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মেই গলছে। সৃষ্টি হচ্ছে অনন্ত জলধারা। হাজার বছর ধরে সে জলধারা ব্রহ্মপুত্র হয়ে পদ্মা মেঘনা যমুনার মিলিত স্রোতধারায় বাংলাদেশের উপর দিয়ে এসে মিলছে সাগরে। সাথে নিয়ে আসছে বিপুল পরিমানে পলি মাটি। এই জলধারা এবং পলি মাটি মিলেমিশে উপকূল জুড়ে চলছে এক অদ্ভুত প্রাকৃতিক রুপান্তর। বেড়ে যাচ্ছে নোয়াখালীর আয়তন। বাড়ছে বাংলাদেশ।
প্রশ্ন হলো যে বিপুল ভূমি নোয়াখালীর উপকূলে জেগে উঠছে তা কি ভাবে আমরা কাজে লাগাবো। নতুন যে চর জাগছে আমাদের জন্য তা প্রকৃতির এক অপার দান। যেখানে একটুকরো জমির জন্য মানুষ হাপিত্তেস করছে সেখানে এত ভূমি যে উঠছে, তা সংরক্ষনের জন্য কোনো ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনা আমরা করতে পারছিনা। এর জন্য কিছু নীতিমালা আছে মাত্র। কিন্তু দৃশ্যত: কোনো কার্যকারিতা তেমন নেই। নতুন জমি দেখলেই জোতদার ভূমি দস্যুদের লেলিহান জ্বিহ্বা লোভে চক চক করে উঠে। তারা হামলে পড়ে সে জমির উপর। খামচে ধরে খাবলে খায় সে জমি। সরকারের প্রথমেই এ ভূমি দস্যুদের নিষ্কৃয় করা হবে প্রথম কাজ। আবিলম্বে টাস্কফোর্স গঠন করে দস্যুদের হাত থেকে এ ভূমিগুলো রক্ষা করতে হবে। এ ভূমিগুলো দেশের অন্যান্য ভুমি গঠন থেকে কিছুটা ভিন্ন। পলিমাটি সমৃদ্ধ অত্যন্ত উর্বর এ ভূমিতে সামান্য চাষেই বিপুল ফসল উৎপন্ন হয়। অপরদিকে দেশে ভূমিহীনের সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এরা অধিকাংশই কৃষক। এ ভূমিহীন কৃষকদের কাজে লাগিয়ে এ ভূমিকে সর্বোচ্চভাবে কী ভাবে কাজে লাগাতে পারি তার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরী।