স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা #### মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

চলে গেলেন প্রবীন সাংবাদিক কামাল উদ্দিন আহ্মেদ






















তকাল রাতে বৃষ্টি হয়নি। তার আগের দিনে ও রাতে অঝোরে বৃষ্টি ঝরেছিলো। আজ সকালটা কিছুটা ঝরঝরে। মেঘ ভাঙ্গা রোদে সকালটা রোদ-মেঘের লুকোচুরি নিয়ে শুরু হলো। আষাঢ়ের ১৯ তারিখ মোঙ্গলবারের সকালটা এরকমই ছিলো। ঠিক এরকম একদিন সকালে কামাল ভাই আমার বাসায় এসেছিলেন। কথা ছিলো আমিই যাব তাঁর কাছে একটা ছবি নিযে। নিঝুম দ্বীপের কেরফা বুড়ির ছবি। বাংলাদেশের একেবারে দক্ষিনে নিঝুম দ্বীপ। সে দ্বীপের এক অসাধারন নারী প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে কেওড়া গাছ ধরে কি ভাবে বেঁচে ছিলো, সে এক কাহিনী। কেরফা বুড়ি ছিলো তার প্রতীক।’৭০ এর ১২ই নভেম্বর, ’৯১ এর ২৯ এপ্রিল। এ দুই গোর্কিকে বুদ্ধি দিয়ে, সাহস দিয়ে দুর্যোগকে ঠেকিয়েছিলেন নিভৃত দ্বীপের কেরফা বুড়ি। ছবিটা আমার কাছে ছিলো। কামাল ভাই তাঁকে নিয়ে লিখেছেন। ছবি দরকার, আমার কাছে ছুটে এসেছেন। বললাম, বসেন। ভরা গলায় বল্লেন, ‘না, রিক্সা দাঁড় করিয়ে রেখেছি’। গেইটের বাইরে রিক্সা দাঁড়ানো। তিনি বসলেননা । দাঁড়িয়েই কথা বলে ছবি নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। আমার দুই সন্তান রৌদ্র আর বৃষ্টি দৌঁড়ে এসে তাঁকে সালাম করলো। স্নেহে আদরে তিনি ওদের সাথে আরো নিবিড় হলেন। আমার বাড়ির সামনের বাগানের করবীর চিরল পাতার ছায়া নিঙড়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন। ঠিক এরকম একটি সকালে তিনি আবার আমার কাছে এলেন সংবাদ হয়ে। সাংবাদিক বিজন সেন সকালে টেলিফোনে সংবাদটি আমাকে দিলেন। বাইরে তখন মেঘ ভাঙ্গা রোদের মাতামাতি। আমার বাসার সামনে বকুল গাছে অনেক বকুল ফুল ধরেছে। পথের উপরই বকুল ফুল ঝরে পড়েছিলো। লম্বা পাঞ্জাবী, লৃুঙ্গী, গলায় সবুজ পাগড়ীর কাপড় ঝুলিয়ে ঝরা বকুলের বিছানো পথ মাড়িয়ে বকুল করবীর গন্ধ মেখে লম্বা সাদা দাড়ির কামাল ভাই আবার আমার বাড়ীর দরজায় এসে দাঁড়ালেন। এবার তিনি কিছু নিতে আসেননি। এক লহমায় স্মৃতির ঝুড়ি নিয়ে এলেন।আমাদের কৈশোরকাল তখনো কাটেনি। সেই ঊনসত্তর সনের কথা । আমরা কয় বন্ধু মেতে থাকতাম সংস্কৃতি লেখালেখি নিয়ে। নোয়াখালী মৌমাছি কঁচি-কাঁচার মেলার সাংগঠনিক আয়োজনে আমারা থাকতাম নিমগ্ন। সেই সময় থেকে তাঁর সাথে আমাদের সম্পৃক্ততা । কেতাদুরস্ত কামাল ভাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী তাঁর। কথার আগে ও পরে শুদ্ধ ইংরেজী ব্যবহার । কখনো কখনো ইংরেজীতে অর্নগল কথা বলেন। মাথায় লেনিনের টুপির মত অবিকল টুপি। দারুন লাগতো। লোকমুখে তাঁর নাম হলো ইংলিশ কামাল। কেন? কারন নোয়াখালীতে কামাল নামে সমসাময়িক আরো আছেন। একই নামে গুলিয়ে যায়। তাই চেনার সুবিধায় এরকম নাম হলো। আরেক জন আছেন নোয়াখালীতে, একই নামে। তিনি বাংলা কামাল। তো এই কেতা দুর¯ত ইংলিশ কামাল কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সাংবাদিকতা দিয়ে। তাও আবার মফস্বল সাংবাদিকতা কিন্তু এ দিয়ে তো আর পেট চলবেনা। এর সাথে শুরু করলেন কনট্রাকটরী ব্যবসা। কিন্তু ব্যবসার চেয়ে তাঁর মন ছিলো সাংবাদিকতার দিকে। দৈনিক বাংলাতেই তিনি সবসময় ছিলেন। স্বাধীনতার পূর্বে তা ছিলো দৈনিক পাকিস্তান। মৃত্যুর পূর্ব পর্যšত তিনি ছিলেন জনকন্ঠের সিনিয়র ষ্টাফ রিপোর্টার। ঊনসত্তর এর গণআন্দোলনে নোয়াখালীর খবরাখবর গুলো নিয়মিত তাঁর কাগজে স্থান পেতো। সত্তুরের ১২ই নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলে র্গাকীতে যে প্রলয় সাধিত হয়েছিলো, তার সকল খবর তিনি অতি সন্তর্পনে যতেœর সাথে পত্রিকায় পাঠাতেন। সে সময় পত্রিকার পাতা জুড়ে থাকত তাঁর তোলা ছবি, ফিচার, রিপোর্ট। তাঁর রিপোর্টের ষ্টাইল ধরণ দেখে আমরা তরুনরা উৎসাহিত হলাম সাংবাদিকতায়। এভাবে তিনি আমাদের অনেককেরই গুরু হয়ে উঠেছিলেন। বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে তাঁর ছিলো একান্ত সম্পৃক্ততা। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় নেতা। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। কলম আর যুদ্ধের ক্ষেত্রে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। সাংবাদিকতায় তিনি যেভাবে নিবিষ্ট ছিলেন তা অনেকের কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। বৃহত্তর নোয়াখালীর গ্রাম, গঞ্জ , দ্বীপ, চরাঞ্চল তিনি চষে বেড়িয়েছেন। যেখানেই সংবাদের গন্ধ পেয়েছেন একা একা ছুটে গেছেন। শোষিত বঞ্চিতদের পক্ষে তাঁর কলম অ¯েত্রর মত গর্জে উঠতো বারবার। ২০০৩-এর ডিসেম্বরে নোয়াখালীর দক্ষিনে চরাঞ্চলে বনদস্যুদের নির্মূলের নামে নৃশংসভাবে চল্লিশ জন কথিত বনদস্যুকে প্রশাসনের সামনেই পিটিয়ে মারা হয়েছিলো। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ছিলো এক ন্যক্কার জনক হত্যাকান্ড। চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। তখন এ হত্যাকান্ডকে অনেকেই সায় দিয়েছিলেন। এমনকি অনেক সাংবাদিক মানবাধিকার সংগঠন এ বিষয়ে টু শব্দ করেনি। কামাল ভাইকে দেখেছি এ নিয়ে প্রচন্ড ক্ষোভে লেখালেখি করেছেন। তিনিই বলেছেন বিনা বিচারে মানুষ হত্যা অন্যায়, চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। তাঁর এই প্রতিবাদী লেখা ও রির্পোটের জন্য তাঁর জীবনের উপর হুমকি পযর্ন্ত এসেছিলো। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। একাই লড়েছেন। ন্যায় নীতির পক্ষে কাউকেই তোয়াক্কা করেননি। স¤প্রতি পত্রিকায় সাহসি কিছু লেখার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মান হানির মামলা হয়েছে। সে মামলা মাথায় নিয়েই তিনি মৃত্যু বরন করেন।বছর দশেক আগের কথা, চরাঞ্চলে ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে। পথে হঠাৎ দেখা হলে তিনি বল্লেন, ‘চল, তোমাকে নিয়ে চরে যাব, কাল সকালে, যেতে পারবে’? আমার সত্যিই জরুরী কাজ ছিলো। কিন্তু তাঁর লোভাতুর সঙ্গও মিস্ করতে চাইছিনা। বল্লাম ঠিক আছে, যাব’। তাঁর সঙ্গ মানেতো একসঙ্গে কাজ করা ও কাজ শেখা। তিনি কার কাছ থেকে যেন একটা হুন্ডা মটর সাইকেল যোগাড় করলেন। সকালেই আমরা দক্ষিনে ছুটলাম। আমি চালাতে চাইলাম কিন্তু তিনি হ্যান্ডেল ছাড়লেন না। সে বয়সেই দক্ষতায় চালাতে লাগলেন হুন্ডা। চরের ভাঙ্গাচোরা রাস্তা । এক অসহায় নারীর ভিটে দখল করতে চাইছে স্থানীয় এক জোতদার। তিনি আমাকে নিয়ে ছুটলেন সেই জায়গায়। পথে একটি পাওয়ার ট্রিলার কেরিয়ারের সঙ্গে মারাত্মক দুঘটনায় পড়লাম আমরা। ব্রেকবিহীন পাওয়ার ট্রিলারের নীচে মটর সাইকেল সহ আমরা প্রায় চাপা পড়ে যাচ্ছিলাম। সরু রাস্তা। কোন রকমে বেঁচে গেলাম। কিন্তু তাঁর একটি পা আটকে গেল গাড়ীর তপ্ত সাইল্যান্সারের সাথে। পায়ের অনেকটা জুড়ে পুড়ে গেলো। ব্যথা ও পেয়েছেন প্রচুর। তবু দেখলাম সবকিছু ঠিকঠাক। নরমাল। সেই স্বভাব সুলভ ইংরেজী, ‘ইট্্স্ নাথিং, বি ইজি’। তিনি আবার গাড়ী চালালেন। প্রায় দেড়শো কিলোমিটার মটর সাইকেল চালিয়ে বিকেলে ফিরলাম আমরা শহরে। ছবি তোলা আর খুব মাছ ধরার শখ ছিলো তাঁর। তখন তিনি কেতা দুরস্ত ইংলিশ কামাল। মাইজদী বড় দীঘির পাড়ে বড়শি ফেলে বসে আছেন। আমার তখন ক্যামেরার নাড়াচাড়া। তাঁর চর্তুদিকে আমরা কয়জন ঘিরে আছি। নানান কথা নানান গল্প। মাছের প্রতীক্ষা। সূর্য ডুবে গেছে। প্রায় আঁধার। আমি তাঁর ছবি তুলতে গেছি। তিনি হেসে বললেন ছবি তো উঠবেনা। আমি বললাম, ‘উঠবে’। তিনি বললেন, ‘যদি উঠে, ‘এখন যে মাছটা ধরবো তা তোমার’। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফিল্ম। সেদিনই ফিল্ম ডেভেলপ করে পরদিন প্রিন্ট করা ছবি তাঁকে দেখালাম। তিনি হেসে পিঠ চাপড়ালেন। বলা বাহুল্য সেদিন তাঁর বড়শিতে কোনো মাছ ধরেনি।‘৯৮ এর বন্যায় নোয়াখালীর অনেক অঞ্চল বন্যার পানিতে দীর্ঘদিন ডুবে ছিলো। বিশেষ করে চাটখিল ও বেগমগঞ্জে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিলো। বৃহত্তর নোয়াখালীর মুজিব বাহিনী প্রধান মাহ্মুদুর রহমান বেলায়েত সহ কামাল ভাই এলাকা গুলো ঘুরে বেড়িয়েছেন। পানি কিছুটা নেমে গেলে চাটখিলের একটা গ্রামে কৃষকরা আবার ধান বুনতে শুরু করে। তাদের দুর্দশা, দুর্যোগের সাথে সংগ্রাম, আবার ঘুরে দাঁড়াবার প্রত্যাশা নিয়ে আমরা রিপোর্ট করবো । তখন আমি দৈনিক মুক্তকন্ঠের জন্য রিপোর্ট করছি। কামাল ভাই’র সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছি গ্রামে গ্রামে। যেখানেই সংবাদের গন্ধ পাচেছন, যাচ্ছেন। জল কাদায় নেমে ছবি তুলছেন। তাঁর এরকম একটি ছবি দূর থেকে জুম লেন্সে তখন তুলেছিলাম। কামাল ভাই জানেন না। প্রিন্টও করেছিলাম। ভেবেছিলাম কখনো ছবিটি তাঁর হাতে দিয়ে সারপ্রাইজ দেবো । তা আর হয়ে উঠেনি। আজ কামাল ভাই নিজেই সংবাদ হয়ে আমাকেই সারপ্রাইজ করে দিলেন।কামাল উদ্দিন আহমেদ ছিলেন আমাদের অনেকের গুরু। তাঁর কাছে আমাদের অনেকের হাতে খড়ি। কিন্তু জীবিত অবস্থায় আমরা তাঁকে সে সম্মাান টুকু দিতে পারিনি। তাঁর অন্তিম যাত্রায় নোয়াখালীর সাংবাদিকরা সবাই তাঁর মরদেহ প্রেস ক্লাবে নিয়ে এলেন। তাঁকে ফুল দিয়ে পুষ্পিত করলেন। তাঁর দেহকে সামনে রেখে এক মিনিট নীরব থাকলেন। নোয়াখালী প্রেসক্লাব নামক ভবনে শোকের কালো পতাকা উঠলো। যে প্রেসক্লাব বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরপরই উদ্বোধন করেন, কামাল ভাই নিজ হাতে ইট বিছালেন। প্রেস ক্লাবকে সম্মানের জায়গায় নিয়ে আসতে চাইলেন। যে প্রেসক্লাব তিনি হৃদয়ে পুষতেন, সেখানে অনেক কলো কষ্ট জমা হয়ে ছিলো। তাঁর সে হৃদয় থেকে কি আমরা কালো কষ্ট গুলো সরাতে পেরেছি !! এ অঙ্গনকে নিয়ে তাঁর আক্ষেপ ও দুঃখের শেষ ছিলনা। সে অনেক কথা। ক্ষোভের অনলে কষ্টের চিতা দাহ করে যন্ত্রণার ছাই ভস্ম উড়িয়ে লাভ নেই। মানুষের ভিতর মানুষের প্রতিনিয়ত রুপান্তর ঘটে। প্রতি ঘটনার পর মানুষ নিজের ভেতর নিজেই পুনঃজন্ম লাভ করে। কেতাদুর¯ত কামাল ভাইয়ের ভিতর এরকম রুপান্তর ঘটে গেলো । প্রথম জীবনের কেতাদুর¯ত কামাল ভাই আর শেষ বয়সের শ্বশ্র“মন্ডিত কামাল ভাই কি একই কামাল উদ্দিন আহম্মেদ!! তাঁর মাইজদী কোর্টের বাসায় যে ড্রইং রুমে বসে আমরা কথা বলতাম, সে ড্রইংরুমে সাদা কাপড়ে মোড়া নির্বাক কামাল ভাইকে দেখে কি বলা যাবে ইনি কোন কামাল উদ্দিন আহমেদ !!! কামাল ভাইয়ের বিদেহী আত্মা চির শান্তি লাভ করুক।